কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২৪, ১০:৫৪ পিএম
আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২৪, ১১:৪৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজে আসছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি’ 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন। ছবি : কালবেলা
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন। ছবি : কালবেলা

সরকারের শস্য সংগ্রহ অভিযান প্রায় ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন। তিনি বলেন, কিছু মিল মালিক ও অল্প সংখ্যক সরকারি কর্মকর্তা মিলে সরকারের শস্য সংগ্রহ অভিযানকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের সাথে যোগসাজশ করে সরকারি কর্মকর্তারা কৃষকদের থেকে কম দামে খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করে নিচ্ছে। এতে কৃষক ঠিকমতো মূল্য পাচ্ছে না। একইভাবে সরকারও তাদের গুদাম রাখার মতো পণ্য সংগ্রহ করতে পারছে না।

বৃহস্পতিবার (৭ মার্চ) বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

ফরাসউদ্দিন বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা বা মধ্যস্বত্বভোগীরা বাজার থেকে শস্য তুলে নিয়ে বাজারে দাম বাড়িয়ে দেয়। এই সময় সরকারের শস্য ভাণ্ডার পর্যাপ্ত পরিমাণ সূচনা থাকায় দাম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা যদি উৎপাদন ও বিপণন সমবায় গড়ে তুলতে পারতাম তাহলে আমরা খাদ্য সমস্যা দূর করতে পারতাম। ১৯৭৪ সালে মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেই দুর্ভিক্ষ তৈরি হয়েছিল। এখনো মধ্যস্বত্বভোগীর এই আমাদের সমস্যার মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য তাদের অস্ত্র দিয়েই তাদের ঘায়েল করতে হবে।

ফরাসউদ্দিন বলেন, সরকারের গুদামের খাদ্যের মজুত ১৫ লাখ টনে নেমে এসেছে বলে গণমাধ্যম থেকে জেনেছি। সরকারের কোনো প্রতিবাদ করেনি। তার মানে ঘটনাটি সত্য। মধ্যস্বত্বভোগী বা অসাদু ব্যবসায়ীদের যদি শায়েস্তা করতে হয় তাহলে সরকারের গুদামের সক্ষমতা ৩০ লাখ টনে নিয়ে যাওয়া উচিত। আমাদের গুদামে যদি এখন ২৫ লাখ টন খাদ্য থাকত তাহলেই বাজারের নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে চলে যেত।

তিনি বলেন, সরকারের কাছে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ থাকলে বর্তমানে যে পরিমাণ রয়েছে তাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়ে খাদ্য দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে ফেলা সম্ভব। বর্তমানে যদি পৃথিবীর ১০০ টাকা খাদ্য বিক্রি করে তাহলে তা বাড়িয়ে ১০ হাজার ট্রাক করে দেয়া যেত। এতে টিসিবি থেকে মানুষ কম দামে খাদ্যদ্রব্য পেত। আর মজুতকারীরা বাধ্য হয়েই খাদ্যদ্রব্যের দাম কমাতে পারত। এজন্য সরকারের খাদ্য মজুতের সক্ষমতা দ্রুত সময়ের মধ্যে বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

সাবেক এ গভর্নর বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই দ্রব্যের ওপর থেকে শুল্ক কমানো হলে ভোক্তারা উপকৃত হয়। অথচ এদেশে শুল্ক কমানোর পরও দ্রব্যের মূল্য কমে না। অর্থাৎ শুল্ক কমানোর সুবিধা ভোগ করে সেই অসাধু ব্যবসায়ী বা মধ্যস্বত্বভোগীরাই।

ফরাসউদ্দিন বলেন, মূল্যস্ফীতি ও কর্মসংস্থান নিয়ে আমরা উভয় সংকটে আছি। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল্যস্ফীতি। এজন্য শঙ্কোচনীতিতে হাঁটতে হচ্ছে আমাদের। অথচ মুদ্রা সরকার হোক কমালে দেশের কর্মসংস্থান কমে যাবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩৮ শতাংশ জনগণ কর্মসংস্থান হীনতায় ভুগছে। এমন পরিস্থিতিতে মুদ্রা সরবরাহ কমালে কর্মসংস্থান আরও কমবে। এতে কর্মসংস্থান নিয়ে আমাদের বড় ধরনের বিপদে পড়তে হবে। আবার মুদ্রা সরবরাহ বাড়ালে বা টাকা ছাপালে মূল্যস্ফীতির টেনে ধরা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী মূল্যস্ফীতি ৫ থেকে ৬ এর বেশি হলেই গরিব মানুষ বিপদে পড়ে। অথচ এখন মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। অর্থাৎ আমরা মূল্যস্ফীতি এবং কর্মসংস্থান নিয়ে উভয় সংকটের মধ্যে আছি।

মূল্যস্ফীতি সুদের হার স্থানীয় মুদ্রার দর ওঠানামা করলে মুদ্রানীতিতে বাস্তবায়ন করা কঠিন। সুতরাং এ তিন বিষয়কে সমন্বয় রেখে স্থানীয় মুদ্রার ধরে রাখাই মুদ্রানীতির চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিন। তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের তিন কোটি মানুষ দরিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে তাদের আর্থিকভাবে চরম বিপদে পড়তে হয়।

তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে মূল্যস্ফীতি গত মাসে কিছুটা কমেছে। অথচ এটা নিয়ে আমরা উল্লাস শুরু করেছি। কিন্তু এটা হওয়ার কথা নয়। আমাদের মূল্যস্ফীতি আরও অনেক কমিয়ে আনতে হবে।

সাবেক এই গভর্নর বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারণা একটা ভাওতাবাজি। বাংলাদেশের মতো দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু করার কোনো সুযোগ নেই। এদেশে দ্রব্যমূল্য এবং আর্থিক অবস্থা স্থিতিশীল রাখতে হলে অবশ্যই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ মধ্যে রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে চাহিদা ও জোগানের সমন্বয় রেখেই এই কাজ সম্পন্ন করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংকে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আরও সফলভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

কারেন্সি সোয়াপের প্রক্রিয়াটা ভুল বলে মনে করেন সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিন। কারণ ব্যাংকগুলো রপ্তানি আয়ের মাধ্যমে যেই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে তা অটোমেটিকভাবে রিজার্ভে যুক্ত হয়। কিন্তু সোয়াপ করার জন্য ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত ডলার পাচ্ছে কোথায়। তাহলে কি তারা মানিলন্ডারিং করছে? আর বাংলাদেশ ব্যাংক কি তাদের সহযোগিতা করছে?

এমন প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, এখন আমাদের কারেন্ট একাউন্ট ব্যালেন্স সারপ্লাস। ব্যাংকগুলোর হাতে চার বিলিয়ন ডলারের বেশি ডলার হোল্ডিং রয়েছে। এসব ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রেখে তারা তারল্য সহযোগিতা নিতে পারছে। আবার তাদের প্রয়োজন হলে এখান থেকে ডলার নিয়ে যেতে পারবে তারা। এতে করে বাজারের তারল্য সমস্যা সহজ সমাধান পাওয়া যাবে বলে মনে করেন গভর্নর।

আব্দুর রউফ তালুকদার আরও বলেন, ডলার কিনে মানুষ বালিশের নিচে রেখে দিয়েছে। এই ডলার ব্যাংকে ফেরানোর জন্য আমরা একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। বিদেশ ভ্রমণ শেষে যে কেউ এসে দেশে এসে প্রতিবার দশ হাজার ডলার পর্যন্ত তার আর এফসিডি একাউন্টে জমা রাখতে পারবে। এ ছাড়া কেউ যদি এয়ারপোর্টে ঘোষণা দেয় যে কোনো পরিমাণ ডলার প্রশ্ন ছাড়াই তার একাউন্টে রাখার সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কার্ব মার্কেট নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে কিন্তু এ বিষয়ে আমরা খুব বেশি মনোযোগ দিতে চাই না। কারণ ব্যাংকে প্রতি বছর ২৭০ বিলিয়ন ডলার লেনদেন হয়। কিন্তু খোলা বাজারের বার্ষিক মার্কেট ৪০ থেকে ৫০ মিলিয়ন ডলার। কার্ব মার্কেটে ডলারের লেনদেন ওঠানামা করার ফলে আমাদের এক্সচেঞ্জ রেট এ কোনো সমস্যা হবে না। রিউমার এর কারণে কার মার্কেটে ডলারের দাম বাড়ে এবং কমে বলে মনে করেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।

গত ছয় মাসে টাকার দাম কমেছে মাত্র ২ শতাংশ। অর্থাৎ আমাদের ডিভালেশন স্টেবল হয়ে এসেছে। নির্বাচনের পর জাতীয় পরিস্থিতিও অনেকটা স্ট্যাবল। আগামী এ ছয় মাসের মধ্যে খুব দ্রুত আমাদের ইনফ্লেশন রেট কমবে। এই মুহূর্তে আমরা জাতীয় চাহিদা কমানোর চেষ্টা করছি। ইনফ্লেশন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে নন ইকোনমিক উদ্যোগ খুবই জরুরি বলে মনে করেন তিনি। আগামী দুই বছরের মধ্যে আর্থিক খাতে গভর্নেন্স ফিরে আসবে বলে জানিয়েছেন আব্দুর রউফ তালুকদার।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মদ পানে মহা সর্বনাশ, ৬ জনের মৃত্যু

বড় ভাই মির্জা ফখরুলের মতোই কবিতা দিয়ে শুরু করলেন মির্জা ফয়সল

সোনারগাঁয়ে টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন

মা ইলিশ রক্ষায় বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার টহল

ন্যাশনাল পিপলস যুব পার্টির মাদকবিরোধী আলোচনা সভা

নিউমার্কেটে চুরির কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জাম, নগদ টাকাসহ গ্রেপ্তার ১

আন্দোলনরত শিক্ষকদের ছত্রভঙ্গ করায় ছাত্রশিবিরের নিন্দা

শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে ইউনিভার্সিটি টিচার্স লিংকের বিবৃতি

কক্সবাজার আদালতে বিচারকের মোবাইল-মানিব্যাগ চুরি

পাঠ্যপুস্তক ছাপার দায়িত্ব হস্তান্তর ‘মাথাব্যথায় মাথা কাটার মতো সিদ্ধান্ত’ : টিআইবি

১০

বিশ্বকাপে ইতিহাস গড়ে ভারতকে হারাল অস্ট্রেলিয়া

১১

মৌসুমি বায়ুসহ আগামী ৪ দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাস

১২

চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা

১৩

এবার উপদেষ্টাদের নিয়ে মুখ খুললেন সামান্তা শারমিন

১৪

ঢাকায় আসছেন জাকির নায়েক

১৫

ছক্কা মেরে ইতিহাস গড়লেন স্মৃতি মান্ধানা!

১৬

উপদেষ্টা রিজওয়ানাকে এনসিপি নেতার হুঁশিয়ারি

১৭

একটি দল ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায় : কফিল উদ্দিন 

১৮

চাকসু নির্বাচনে নতুন প্রত্যয়ে ছাত্রদল

১৯

বন্দর ব্যবসায়ী নেতারা / মাশুল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধের ষড়যন্ত্রের অংশ

২০
X