একটি বাসযোগ্য শহরে কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলাশয় থাকা দরকার হলেও রাজধানী ঢাকায় তা আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। জলাধারগুলো নির্বিচার দখল করা হয়েছে। ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ), নগর উন্নয়ন আইন, জলাধার সংরক্ষণ আইন ও পরিবেশসংক্রান্ত আইনকে অমান্য করে পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার ডিআইটি পুকুর দখলসহ এ নগরীর আরও বিভিন্ন পুকুর-জলাধার দখল ও ভরাট হচ্ছে, যা খুবই উদ্বেগের বলে উল্লেখ করেছেন পরিবেশবাদী ও সংরক্ষণকর্মীরা।
বৃহস্পতিবার (২২ জুন) জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘ঢাকায় পুকুর ও জলাধারের প্রয়োজনীয়তা এবং সংরক্ষণে করণীয়’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব কথা বলেন পরিবেশবিদ ও পরিবেশকর্মী, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের গবেষক ও বিশেষজ্ঞ, সংসদ সদস্য এবং সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোট (বাংলাদেশ নেচার কনজারভেশন অ্যালায়েন্স-বিএনসিএ) ও গেন্ডারিয়ার ডিআইটি পুকুর রক্ষা আন্দোলনের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় সেমিনারটি। বিএনসিএর আহ্বায়ক ও স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার সভাপতিত্ব করেন। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার-আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ।
প্রবন্ধে বলা হয়, ঢাকা মহানগরীর অবশিষ্ট ৩২৭ পুকুর ও জলাশয়ের মধ্যে ৮৬টি (যা প্রায় ২৬%) এখন সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালী ব্যক্তির দখলের পথে। এই জলাধারগুলোর মধ্যে ছয়টি দখল হচ্ছে সরকারি উদ্যোগে, ৭৯টি দখল হচ্ছে বেসরকারি উদ্যোগে এবং বাকি একটি দখল হচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে।
জলাশয় দখল ও কমে যাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি-বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘পানির শহর ঢাকাকে আমরা কারবালায় পরিণত করেছি। এই নগরী সবচেয়ে অবসবাসযোগ্য নগরীতে পরিণত হয়েছে।’
রাজউককে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘আমাদের হাউজিংগুলো আকিকা করে নাম বদলে ফেলছে। রাজউক সেখানে অসহায়। সাংঘাতিক অস্বচ্ছ এ প্রতিষ্ঠান নিজেই জলাশয় ভরাট করে হাউজিং করছে। অপরদিকে মেয়রদের উন্নয়নের ধারণা জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও কাজ করছে। ঢাকা এখন বাগানবিহীন নগরীতে পরিণত হয়েছে। এত কিছু হলে আমাদের জলাধার আইন ও রাজউক দিয়ে কী হবে। ঢাকার উন্নয়ন পরিকল্পনা জনগণ করবে, সেটার বাস্তবায়ন করবে সিটি করপোরেশন ও রাজউক।’
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘এ নগরীর কোনো দর্শন নেই। মেয়রের উন্নয়ন ধারণা জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। আমাদের উন্নয়নের দর্শন পাল্টাতে হবে। প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ, জলাশয় ইত্যাদিকে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের উন্নয়নের চিন্তা করতে হবে। গেন্ডারিয়া পুকুরসহ বিভিন্ন পুকুর, জলাশয় ও মাঠ রক্ষার দায়িত্ব যাদের, তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করায় এসব হারিয়ে যাচ্ছে। প্রভাবশালী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখল করে নিচ্ছে।’
স্থানীয় লোকজনের সোচ্চার ভূমিকার প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘গেন্ডারিয়ার পুকুর রক্ষা পাচ্ছে স্থানীয়দের প্রতিবাদী ভূমিকার কারণে। ডিআইটি পুকুর রক্ষায় আন্দোলন করে স্থানীয়রা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।’
ঢাকা নগরীর বিভিন্ন জলাশয় ও মাঠ রক্ষায় রাজউকের ব্যর্থতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রাজউকের দ্বৈতনীতি ও বিতর্কিত ভূমিকার কারণে পুকুর ও জলাশয় দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন দর্শন ছাড়া রাজউক বিভিন্ন কাজ করছে। রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে ২০ বছরের একটা পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে এ নগরীর প্রাণ ফিরিয়ে আনা যায়।’
আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে পরিবেশ ইস্যু যাতে গুরুত্ব পায়, সেজন্য এখন থেকে পরিবেশবাদীদের কাজ করার ওপর তিনি তাগিদ দেন। বলেন, পরিবেশ বিধ্বংসী এবং নদী ও জলাশয় দখলদাররা যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারে, সে ব্যাপারে পরিবেশবাদীদের ভূমিকা রাখতে হবে।
সেমিনারে আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা-৪ আসনের সংসদ সদস্য এমপি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক বজলুর রশীদ; বিএনসিএর যুগ্ম আহ্বায়ক ও নোঙর ট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী সুমন শামস, বিএনসিএর সদস্য সচিব ও সেভ আওয়ার সির সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ আনোয়ারুল হক ও নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইবনুল সাঈদ রানা।
আরও বক্তব্য দেন পরিবেশসংক্রান্ত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ইনিশিয়েটিভ ফর পিস (আইএফপি)’-এর চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান, যাত্রী অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক কেফায়েত উল্লাহ চৌধুরী শাকিল, গেন্ডারিয়া ডিআইটি প্লট পুকুর রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক ইব্রাহীম আহমদ রিপন প্রমুখ।
নেচার লাভিং পিপল (এনএলপি)-এর সভাপতি এহসানুল হক জসীম, সেভ ফিউচার বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়ক নয়ন সরকার, বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস), পরিবেশ উদ্যোগ, সম্মিলিত জলাধার রক্ষা আন্দোলন, ব্লু গ্রিন ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। পুরান ঢাকার বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারাসহ গেন্ডারিয়া এলাকার সচেতন নাগরিকরা সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন।
আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘আমাদের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় বর্তমানে ৬৩টি খাল, ১৩টি লেক ও একটি আদি চ্যানেলের অস্থিত্ব রয়েছে। নিজেদের প্রয়োজনে এসব পুকুর ও জলাধার রক্ষা করতে হবে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউক কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে ঢাকার অবশিষ্ট জলাধারগুলো পুনরুদ্ধার করতে পারে।’
তিনি বলেন, ’আইন অনুযায়ী যেকোনো ধরনের জলাধার ভরাট নিষিদ্ধ। ব্যক্তি মালিকানাধীন হলেও জলাধার ভরাট করা যে যাবে না, এ ব্যাপারে রাজউকে সার্কুলার ইস্যু করতে পারে। রাজউক আরও সক্ষম ও সক্রিয় হলে ঢাকার জলাধার রক্ষা পাবে।’
এ ছাড়া সরকারিভাবে জলাধারের এখনও কোনো তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। এটা করা দরকার। প্রতিটি পুকুরের সামনে এখনোই সাইনবোর্ড টানিয়ে দেওয়ার দাবি জানান।
সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি বলেন, ’পুরান ঢাকার ডিআইটি পুকুর দখলমুক্ত রাখার ব্যাপারে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যারা এই পুকুর দখল করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ও বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান।’
রাজউক কর্তৃক উচ্ছেদ হওয়ার পরও ডিআইটি পুকুরে যে অবশিষ্ট স্থাপনা রয়েছে, তা সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তিনি কাজ অব্যাহত রাখবেন বলে ঘোষণা দেন। এ ছাড়া ঢাকাসহ সারা দেশের কোথাও পুকুর ও জলাশয় ভরাট করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
ফায়ার সার্ভিসের বজলুর রশীদ ঢাকা নগরীতে অগ্নিনির্বাপণে পুকুরের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ’পুরান ঢাকার মতো ঘনজনবসতিপূর্ণ ও সংকীর্ণ রাস্তাসংবলিত এলাকায় অগ্নি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ডিআইটি পুকুরসহ বিভিন্ন পুকুরের গুরুত্ব অপরিসীম। পুরান ঢাকায় নতুন করে আরও কিছু পুকুর খনন করা একান্ত প্রয়োজন।’
মন্তব্য করুন