কোমর সমান পানি অথবা হাঁটু পরিমাণ কাদা মাড়িয়ে নীড়ে ফেরা সন্দ্বীপের মানুষের নিত্যদিনের ঘটনা। শত বছর ধরে এভাবেই চলে আসছে সন্দ্বীপের মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থা। তবে এবার কাঁদা বা পানি মাড়িয়ে ঘরে ফেরার দিন শেষ হতে চলেছে সন্দ্বীপবাসীর।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ নৌ-রুটে আগামী ২৪ মার্চ চালু হচ্ছে ফেরি সার্ভিস। এতে করে সন্দ্বীপের মানুষের যাতায়াতের দুঃখ দুর্দশা একদিকে যেমন ঘুচবে, তেমনি খুলবে সম্ভাবনার নতুন দ্বার।
গবেষকরা বলছেন, ফেরি সার্ভিস চালু হলে সন্দ্বীপের কৃষি, মৎস্যসহ অর্থনীতি, বাণিজ্য ও স্বাস্থ্যখাতে আসবে নতুন গতি। এছাড়া পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে সাজানো যাবে দ্বীপের সমুদ্র উপকূলকে। যদিও পুরো সুবিধা পেতে রয়েছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও।
চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপে প্রায় ৪ লাখ মানুষ বসবাস করে। দৈনন্দিন কাজ, জীবন-জীবিকা, শিক্ষা, চিকিৎসার মতো জরুরি কাজে এ জনপদের বাসিন্দাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে জেলা শহর চট্টগ্রামে আসা-যাওয়া করতে গিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়। চট্টগ্রাম সমুদ্র উপকূল ও সন্দ্বীপের মাঝখানে রয়েছে উত্তাল নৌ-চ্যানেল, এই নৌপথের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৭ কি.মি.। এ পথ পাড়ি দিতে শিশু, নারী ও বয়োবৃদ্ধ যাত্রীরা নৌযাত্রায় প্রতিনিয়ত অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েন।
কখনও এক বুক, কখনো বা এক কোমর পানি, আবার কখনো এক হাঁটু পরিমাণ কাঁদা মাড়িয়ে কূলে উঠতে হয়। সূর্য ডোবার পর বন্ধ হয়ে যায় মূল ভূ-খণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় দিনের পর দিনও থাকতে হয় বিচ্ছিন্ন অবস্থায়। এসব কিছু বিবেচনা করে ২০২২ সালে চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপে ফেরি সার্ভিসের উদ্যোগ নেওয়া হয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সন্দ্বীপের সন্তান সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানের তত্ত্বাবধানে কাজে নতুন করে গতি পায়।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিওটিএ) সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের বাঁশবাড়িয়া ঘাট থেকে ফেরি সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া এলাকায় গিয়ে ভিড়বে৷ এজন্য বাঁশবাড়িয়া ঘাটে বেড়িবাঁধ থেকে সাগরের ফোরশোর এলাকায় ব্লক দিয়ে প্রায় ৮০০ মিটারের সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। একইভাবে সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটে নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ৫০০ মিটার সড়ক। এছাড়া গুপ্তছড়া ঘাট এলাকায় আরও ২০০ মিটার সড়ক নির্মাণ করছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। ফেরি চলাচলে নির্মাণ করা হয়েছে জেটি, গাড়ি পার্কিং ইয়ার্ডসহ অন্যান্য অবকাঠামো। দুই পাশে পল্টুন বসানাও শেষ।
বুধবার (১৯ মার্চ) একবার পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হয়েছে। আরও কয়েক দিন পরীক্ষামূলকভাবে চলবে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) সূত্রে জানা যায়, সন্দ্বীপ-চট্টগ্রাম রুটে আপাতত চাঁদপুর-শরীয়তপুর রুটে চলা কপোতাক্ষ ফেরি চলবে। এই রুটে একটি নতুন ফেরি তৈরি করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তি শিগগিরই একটি আধুনিক ফেরি তৈরি করা হবে।
বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তারা জানান, কপোতাক্ষ ফেরিতে ছোট গাড়ি ৩৩ থেকে ৪০, ট্রাক ১২ থেকে ১৫, বাস ১২টা চলতে পারবে। মোটরসাইকেলের বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। ফেরি দিনে দুইবার আসা যাওয়া করবে৷ সময়সূচি জোয়ার-ভাটার বিষয় বিবেচনা করে চূড়ান্ত করা হবে।
বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক মো. কামরুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, আমাদের কাজ প্রায় শেষ। আমরা এখন পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকদিন ফেরি চালাব। আগামী ২৪ মার্চ ফেরি সার্ভিস উদ্বোধন হবে। আর যে কাজগুলো বাকি আছে, সেগুলো উদ্বোধনের আগে শেষ হয়ে যাবে।
বিআইডব্লিউটিসির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার গোপাল মজুমদার কালবেলাকে বলেন, এই রুটে আপাতত চাঁদপুর-শরীয়তপুর রুটে চলা কপোতাক্ষ ফেরি চলাচল করবে। এই রুটের জন্য শিগগিরই নতুন ফেরি তৈরি করা হবে। একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কপোতাক্ষ ফেরি দিনে দুইবার যাওয়া আসা করবে।
দুবাই প্রবাসী মুসলেহ উদ্দীন বলেন, যাতায়াত ব্যবস্থার করুন পরিস্থিতির কারণে সন্দ্বীপে তেমন যাওয়া হয় না। ফেরি চালু হলে ঈদের বন্ধে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে গাড়ি সরাসরি সন্দ্বীপ যেতে পারব।
রয়েছে কিছু শঙ্কা বর্ষা মওসুমে যাতায়াতে সন্দ্বীপবাসীকে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আর এসময় উত্তাল সাগরে ফেরি চলাচল করতে পারবে কিনা শঙ্কা রয়েছে। বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তাদের মতে, এই ফেরি বর্ষা মৌসুমে চালানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তাদের টার্গেট অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এসময় সাগর শীতল থাকে। বাকি সময় হয়ত এই ফেরি চালানো যাবে না।
আবার এই ফেরি ব্যবসায়ীদের জন্য কতটা সুফল বয়ে আনবে তা এখনও নিশ্চিত না সন্দ্বীপের ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, চট্টগ্রাম থেকে যে গাড়িগুলো আসবে, সেগুলো রাস্তা ছোট হওয়ায় সরাসরি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত আসতে পারবে না। মালামাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠার পর্যন্ত আনতে কয়েকবার গাড়ি পরিবর্তন করতে হবে। সময়ের সাথে ব্যয়ের পরিমাণও বাড়তে পারে।
সন্দ্বীপের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ওমর ফয়সাল কালবেলাকে বলেন, ফেরি থেকে আমরা কতটুকু লাভবান হতে পারব, তা এখনো বুঝা যাচ্ছে না। এখানে অনেকগুলো বিষয় জড়িত। প্রথমত, ট্রাকগুলো সরাসরি আমাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত আসতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, ট্রাকগুলো আমাদের ভাড়া নিতে হবে। ক্ষেত্র বিশেষ ট্রাক একদিনের বেশিও থাকতে হতে পারে। আসা যাওয়াতে, থাকা সব মিলিয়ে কি পরিমাণ খরচ হবে তা ফেরি চালু হওয়ার পর বুঝা যাবে। যদি সবমিলিয়ে খরচ নৌপরিবহণ থেকে কম আসে, তবেই বলা যাবে ফেরি ব্যবসায়ীদের জন্য সুফল বয়ে আনবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. ফুয়াদ হাসান কালবেলাকে বলেন, যুগ যুগ ধরে সন্দ্বীপের মানুষের প্রধান সমস্যা ছিল যাতায়াত। এটার সঙ্গে মানবিক মর্যাদার বিষয়ও জড়িত। ফেরি সার্ভিস চালু হলে অর্থনৈতিকভাবেও বিরাট পরিবর্তন সাধিত হবে। সন্দ্বীপের মানুষ এমনিতেই অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা স্বাবলম্বী। যাতায়াত সমস্যা কিছুটা সমাধান হলে তারা সন্দ্বীপে বিনিয়োগ করবে। যাতায়াতের সুব্যবস্থা না থাকায় ব্যবসায়ীরা অনেক ধরনের ব্যবসার চিন্তা করেও মুখ ফিরিয়ে নিত। এখন তারা পুনরায় নতুন ব্যবসার কথা ভাববে। জেগে উঠা নতুন চরে বিভিন্ন কলকারখানা গড়ে উঠবে। সন্দ্বীপে যে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা আছে, তারও বিকাশ ঘটবে।
সন্দ্বীপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিগ্যান চাকমা কালবেলাকে বলেন, ফেরি চালু হলে সন্দ্বীপে আমূল পরিবর্তন সাধিত হবে। মানুষ চাইলেই গাড়ি নিয়ে সন্দ্বীপ চলে আসতে পারবে। বিভিন্ন পণ্যের দাম কমবে। পর্যটন খাতের বিকাশ হবে। স্পিডবোট ফেরি ঘাট দিয়ে যাতায়াত করতে পারবে। এতে করে মানুষকে কাদা-পানি মাড়াতে হবে না। সবমিলিয়ে সন্দ্বীপের মানুষের জীবন যাত্রার মান আরও উন্নত হবে।
ছবি : পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হয়েছে ফেরি।
মন্তব্য করুন