সাইদুল ইসলাম, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:০৩ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
ফল কেলেঙ্কারি

শাস্তি পাওয়া সেই এসএসএ’র হাতেই রেজাল্ট তৈরির কাজ!

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, চট্টগ্রাম। ছবি : সংগৃহীত
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, চট্টগ্রাম। ছবি : সংগৃহীত

দীর্ঘদিন ধরেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, চট্টগ্রামের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিতর্কিত সব কর্মকাণ্ডে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। দায়িত্বশীল কর্তা থেকে শুরু করে কর্মচারীদের মধ্যেও রয়েছে দ্বন্দ্ব, পক্ষ-বিপক্ষ ও অভ্যন্তরীণ নানা কোন্দলও। ফলে এই বোর্ডের ভেতরে লেগেই আছে সমস্যা ও ধূম্রজাল। এবার ফলাফল কেলেঙ্কারির শাস্তির পাওয়া সিস্টেম এনালিস্টের হাতে রেজাল্ট তৈরির কাজ বা দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টিও ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়ে উঠছে নানা অঙ্গনে। আলোচনা হচ্ছে ব্যাপকভাবে। সেই ফল জালিয়াতির ঘটনায় আদৌ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হবে কি না সেই প্রশ্ন সংশ্লিষ্টদের।

অপরদিকে ফল কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে শাস্তি পাওয়া চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সাবেক সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট কিবরিয়া মাসুদ খানকে (এসএসএ) চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে সদ্য সমাপ্ত এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে ফের জালিয়াতির আশঙ্কা করছেন ‘খোদ’ বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

তারা বলছেন, টেকনিক্যাল সহযোগিতার জন্য কিবরিয়াকে নিয়োগ না দিয়ে অন্য বোর্ডের সহযোগিতা নেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু সচিবের ইচ্ছায় তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের বর্তমান সচিব ও সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথের যোগসাজশে এলপিআরে থাকা কিবরিয়াকে গত ১৫ এপ্রিল থেকে দৈনিক ২ হাজার টাকা মজুরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসময় তিনি পিআরএলসংক্রান্ত অন্যান্য সুবিধাও ভোগ করবেন। ২০২১ সালে ফলাফল কেলেঙ্কারিতে তৎকালীন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথও দায়ী হয়েছিলেন। কিবরিয়া শাস্তি পেলেও ক্যাডার কর্মকর্তা হওয়ায় নারায়ণ চন্দ্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিলেন তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোস্তফা কামরুল আখতার। তা ছাড়া ফলাফল জালিয়াতির অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন হয়েছে। কমিটিকে আগামী সাত কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। গত বুধবার মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (কলেজ-১) মো. তারিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে এই আদেশ দেওয়া হয়।

এর আগে গত ১ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা বিভাগের উপসচিব শাহীনুর ইসলাম স্বাক্ষরিত আদেশে ১৫ দিনের মধ্যে কমিটি গঠনের মাধ্যমে তদন্ত পূর্বক রিপোর্ট দিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছিল। সেই চিঠির প্রেক্ষিতে কমিটি গঠিত হয়েছে; তবে অভিযুক্তকে পদে রেখে সুষ্ঠু তদন্ত সম্ভব কি না তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। এই অবস্থার মধ্যে ফলাফল জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কিবরিয়াকে নিয়োগ দিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন সচিব নারায়ণ চন্দ্র।

এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির আহবায়ক মাধ্যমকি ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক প্রফেসর মো. আমরি হোসেন কালবেলাকে বলেন, ঈদের ছুটিসহ নানা বিষয়ে ঘিরে একটু সময় লাগছে। আগামী মাসের প্রথম দিকে এটার তদন্ত কাজ শুরু করব। তবে কেউ চেয়ারে বা দায়িত্ব থাকার বিষয়টা এক জিনিস আর তদন্তের কাজের বিষয়টা আরেক জিনিস। এতে কোনো কাজের সঙ্গে কোনোটাই বাধাগ্রস্ত হবে না। তবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তে সঠিক তথ্য ওঠে আসবে বলে আমি মনে করছি।

কিবরিয়াকে নিয়োগের নেপথ্যের কারণ কী?

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সদ্য সমাপ্ত এসএসসি পরীক্ষার ই-টাইপ (পরীক্ষার হল থেকে যে অংশ পাঠায়) এবং এম-টাইপ (এমসিকিউ) ওএমআর স্ক্যানিং সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে এইচ-টাইপ ওএমআর (খাতা মূল্যায়নের পর প্রধান পরীক্ষকের কাজ থেকে যে অংশটি আসে) স্ক্যানিংয়ের কাজ চলমান। ফলে এখনো পর্যন্ত সিস্টেম এনালিস্টেও কোনো কাজ নেই। চলতি মাসের শেষের দিকে সিস্টেম এনালিস্টের কাজ শুরু হবে। কিন্তু তার ১৫ দিন আগেই কিবরিয়াকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। কিবরিয়া যোগদানের পর বোর্ডেও সপ্তম তলার (পরীক্ষাসংক্রান্ত গোপনীয় কাজ হয় এখানে) সিসিটিভির পাসওয়ার্ড পরিবর্তন ও রেকর্ড বন্ধ রাখা হচ্ছে। মূলত ফলাফল জালিয়াতির আলামত নষ্ট করতেই কিবরিয়াকে আনা হয়েছে। কারণ কিবরিয়া ছাড়া এসব জালিয়াতির কাজ অন্য কেউ পারবে না। এ ছাড়া কিবরিয়াকে নিয়োগ না দিয়ে অন্য বোর্ডের সহযোগিতা নিয়েও ফলাফল তৈরির সুযোগ আছে।

বোর্ড সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, দিনাজপুর বোর্ডের পুরো ফলাফল রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বোর্ডের ফলাফল তৈরি করে দেয় যশোর বোর্ড। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডও সহায়তা নিতে পারত; কিন্তু নিজেদের অপকর্ম ঢাকতেই তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের বর্তমানে সচিব এবং চেয়ারম্যানের চলতি দায়িত্বে থাকা প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র নাথের ছেলে নক্ষত্র দেবনাথ ২০২৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। কেবল বাংলা ছাড়া সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পায়। কিন্তু চতুর্থ বিষয়ে জিপিএ-৫ পাওয়ায় সামগ্রিক ফলাফলে জিপিএ-৫ পেয়েছিল। বাংলায় জিপিএ-৫ না পাওয়ায় তার পরিবারের পক্ষ থেকে পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করতে যায়। আবেদন করতে গিয়ে দেখে কে বা কারা আগে থেকে সব বিষয়ের জন্য আবেদন করে রেখেছেন। এ ঘটনায় ছেলের পক্ষে তার মা বনশ্রী নাথ পাঁচলাইশ থানায় গত ৪ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে জিডি করেন। সেই জিডিতে পুনঃনিরীক্ষণের জন্য আবেদন করেছেন তা বের করার আবেদন জানানো হয়।

অন্যদিকে, বর্তমান পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক একটি চিরকুটের দিয়ে সচিবের ছেলের পুনঃনিরীক্ষণ না করার নির্দেশ দেন। অথচ পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করলেই সেটি যাচাই করার কথা। কারণ পুনঃনিরীক্ষণে ফলাফল বাড়ে কিন্তু প্রাপ্ত নম্বর বা গ্রেড কমে না। এক্ষেত্রে চিঠি না দিয়ে চিরকুটের মাধ্যমে বন্ধ রাখায় বোর্ড সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সন্দেহ আরও গাঢ় হয়।

পাঁচলাইশ থানা পুলিশ তদন্ত করে দেখতে পায় পুনঃনিরীক্ষণের আবেদনে রেফারেন্স মোবাইল নম্বরও দেওয়া হয়েছে বোর্ডে সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল আলীমের। এ ঘটনায় আবদুল আলীমকে পুলিশ ডাকলে তিনি বলেছিলেন,‘ কে বা কারা আমার মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে আবেদন করেছেন আমি জানি না। এ ছাড়া পুনঃনিরীক্ষণে রেফারেন্স নম্বরের কোনো প্রয়োজন হয় না।’ তিনি এ ঘটনায় প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র নাথকে দায়ী করে পাল্টা আরেকটি জিডি করেন কোতোয়ালি থানায়। পরে পুলিশ জিডির রিপোর্ট সাবমিটের পর সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সাইবার ট্রাইবুলালে মামলা করেন বনশ্রী নাথ। মামলয় প্রফেসর আবদুল আলিম ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস আলীকে আসামি করা হয়েছে। মামলাটি তদন্ত করছে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আবু সাঈদের কবর জিয়ারত করলেন ইআবির ভিসি 

গণহত্যাকারীরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পরিকল্পনা করছে : আসিফ মাহমুদ

উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠকে হাসনাতরা

আ.লীগের বিচার ত্বরান্বিত করুন : জামায়াতে আমির

জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র উপহার দিয়েছিলেন: নয়ন

রাজপথেই রয়েছেন আন্দোলনকারীরা

জুলাই ঘোষণাপত্র ছাড়া ঘরে না ফেরার সিদ্ধান্ত আন্দোলনকারীদের 

তিন দফার একটি বাকি থাকতেও রাস্তা ছাড়বো না : হাসনাত

তারেক রহমানের মা ও শাশুড়ির আরোগ্য কামনায় দোয়া মাহফিল

আইইউবিএটি’র প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. এম. আলিমউল্যা মিয়ানের অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত

১০

৫ হাজার বৌদ্ধ বিহারে উদযাপিত হবে বুদ্ধপূর্ণিমা 

১১

দল হিসেবে আ.লীগকে বিচারের আওতায় আনতে হবে : সাকি

১২

আরও কমানো হলো সোনার দাম

১৩

আ.লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধের ঘোষণায় শাহবাগে ছাত্র-জনতার উল্লাস

১৪

মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে নেতানিয়াহু-ট্রাম্পের দূরত্ব বাড়ছে : ইসরায়েলি মিডিয়া

১৫

বিএনপিপন্থি প্রকৌশলীদের ওপর আওয়ামীপন্থিদের হামলা

১৬

জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে যে সিদ্ধান্ত এলো

১৭

যুদ্ধবিরতি কার্যকর / ভারত এখনো স্থগিত রেখেছে পাক-ভারত সিন্ধু জলচুক্তি

১৮

সিএনজি ফিলিং স্টেশনের কমিশন ৫ টাকা ১০ পয়সা বাড়ানোর দাবি

১৯

বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ

২০
X