ঢাকায় শুরু হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক পর্যটন মেলা— বাংলাদেশ ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ফেয়ার (বিটিটিএফ)। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ট্যুরিজম বাণিজ্য সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) এ মেলার আয়োজন করছে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ কনফারেন্স সেন্টারে (বিসিএফসিসি) এ মেলা শুরু হবে আগামী ৩০ অক্টোবর। তিন দিনব্যাপী এ মেলা চলবে ১ নভেম্বর পর্যন্ত।
সোমবার (০১ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আয়োজিত টোয়াব বিটিটিএফ ২০২৫ প্রেসমিট ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন টোয়াবের পরিচালক (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক-রিলেশন) মো. ইউনুছ। এ সময় বিটিটিএফের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন শুভাশিস ভৌমিক।
মেলার প্রেক্ষাপট ও সার্বিক প্রস্তুতি সম্পর্কে বর্ণনা করেন টোয়াবের পরিচালক (বাণিজ্য ও মেলা) মো. তাসলিম আমিন শোভন। তিনি জানান, এবারের মেলা হবে ১৩তম সংস্করণ এবং মেলাটি আগের সব বছরের তুলনায় অনেক বৃহৎ পরিসরে, আকর্ষণীয় ও জাঁকজমকপূর্ণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই মেলার সার্বিক সহযোগিতায় রয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড, বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট পুলিশ এবং এফবিসিসিআই। প্রথমবারের মতো কোনো মেলায় সরাসরি অংশগ্রহণ করছে টার্কিশ এয়ারলাইন্স।
মেলায় গোল্ড স্পন্সর হিসেবে ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক হোটেল চেইন প্রতিষ্ঠান আইএসজি, হসপিটালিটি পার্টনার হিসেবে আছে ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকা, ক্রাউন প্লাজা গুলশান, হলিডে ইন ঢাকা। এছাড়া, এই আয়োজনের সাসটেইনেবেলিটি পার্টনার মিশন গ্রিন বাংলাদেশ, ক্রুজ পার্টনার সিম্ফনী অব ওয়েভ, স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার এটিজেএফবি, পিআর পার্টনার ওপাস, টেকনোলজি পার্টনার এমথ্রিসিক্সটি, ডিজিটাল পার্টনার মায়েস্ট্রো ডিজিটাল, জিডিএস পার্টনার সেইবার বাংলাদেশ, ট্রান্সপোর্ট পার্টনার কনভয় সার্ভিস এবং ভেন্যু পার্টনার বিসিএফসিসি। একই সঙ্গে এতে পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার জাতীয় পর্যটন সংস্থা ও ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশন তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে; আরও বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে মেলায় অংশগ্রহণের আলোচনা চলমান রয়েছে।
মেলায় মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও তুরস্কের ট্যুর অপারেটর ও ট্রাভেল এজেন্টরা অংশগ্রহণ করছেন। আন্তর্জাতিক ও দেশি এয়ারলাইন্স, ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুর অপারেটর, হোটেল, রিসোর্ট, ক্রুজ লাইনার প্রতিষ্ঠানগুলো এক্সিবিউটর হিসেবে অংশগ্রহণ করছে। এবারের মেলায় মেডিকেল ট্যুরিজমের জন্য আলাদা জোন থাকবে।
মেলায় ৪টি হলে প্যাভিলিয়নসহ মোট ২২০টি স্টল থাকবে। এবারের মেলায় ২৫০-এরও বেশি এক্সিবিউটর, ২০টিরও বেশি দেশের অংশগ্রহণ, ২ হাজারের বেশি বাণিজ্যিক প্রতিনিধি এবং ৫০ হাজারেরও বেশি দর্শনার্থী উপস্থিত থাকবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। মেলায় অন্যান্য ইভেন্টের মধ্যে থাকবে বিটুবি সেশন, সেমিনার ও রাউন্ড টেবিল আলোচনা। এছাড়া মেলায় আগত দর্শনার্থীদের জন্য প্রতিদিন সাংস্কৃতিক আয়োজন এবং দেশের পর্যটন গন্তব্যের ওপর প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শিত হবে। এছাড়াও থাকবে আকর্ষণীয় র্যাফেল ড্র, বিজয়ীদের জন্য থাকবে দারুণ সব পুরস্কার।
দেশি-বিদেশি প্রদর্শকদের রেজিস্ট্রেশন আরও সহজ ও আধুনিক করার লক্ষ্যে বিটিটিএফ ওয়েবসাইটে নতুন সব ফিচার যোগ করা হয়েছে। এমনকি বিশ্বের যে কোনো দেশ থেকে দর্শনার্থীরা অনলাইনে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে মেলার সব তথ্য নিজ দেশে বসেই দেখার সুযোগ পাবেন। বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো মেলার অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে; আজ যার মোড়ক উন্মোচন করা হলো। এই অ্যাপের মাধ্যমে একজন দর্শনার্থী ভেন্যুর ম্যাপ ও স্টলের নাম দেখতে পারবেন এবং মেলা প্রাঙ্গণ নির্বিঘ্নে ঘুরে দেখতে পারবেন। এছাড়া, দেশি-বিদেশি এক্সিবিউটররা এখানে তাদের জন্য মূল্যবান সব তথ্য পাবেন, যা তাদের ব্যবসাকে আরও প্রসারিত করবে।
বিটিটিএফের এবারের আয়োজনটির মাধ্যমে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব ট্যুরিজমকে প্রচার করা হবে। পরিবেশের ক্ষতি না করে কীভাবে দেশের পর্যটনের বিকাশ করা যায়, সে বিষয়গুলোই প্রচার করা হবে এখানে। এজন্য পুরো মেলায় প্লাস্টিক ব্যবহার হবে না। মেলার প্রচারে দেশের ৮টি বিভাগের পর্যটন স্পটে চলবে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি ও টেকসই পর্যটনের প্রচারণা।
লোকজ কারুশিল্প একটি দেশের ঐতিহ্য বহন করে, পাশাপাশি কারুশিল্পের পণ্যগুলো পরিবেশবান্ধব হয়ে থাকে। বাংলাদেশের কারুশিল্পের কয়েকশ বছরের ঐতিহ্য রয়েছে, যা এখনও দেশের বিভিন্ন জেলায় চর্চা হয়ে আসছে। বাংলাদেশের প্রায় হারিয়ে যেতে থাকা এই শিল্পকে সবার মাঝে তুলে ধরতে বিটিটিএফ এবার মেলাপ্রাঙ্গণে লোকজ কারুশিল্পের জোন করছে, যেখানে বাংলাদেশের প্রান্তিক কারুশিল্পীরা তাদের পণ্য প্রদর্শন করবেন, বিক্রি করবেন এবং কীভাবে এসব বানানো হয় তা দেখাবেন।
ট্যুরিজম মেলাকে উৎসবে পরিণত করার উদ্দেশ্যে, সবার মাঝে মেলার আগ্রহ ছড়িয়ে দিতে এবং সবাইকে ট্যুরিজমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য থাকছে ভ্রমণের ছবি, ভিডিও এবং ভ্রমণ গল্পের প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের ছবি, ভিডিও ও গল্প মেলাপ্রাঙ্গণে প্রদর্শন করা হবে। এছাড়া, প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের জন্য থাকছে বিশেষ পুরস্কার।
ট্যুরিজম, হসপিটালিটি এবং অ্যাভিয়েশন নিয়ে প্রতিনিয়ত প্রতিবেদন ও তথ্য দিয়ে যারা টুরিস্টদের সবসময় অবহিত করে থাকেন, সেসব সাংবাদিকদের নিয়ে থাকছে বিশেষ আয়োজন। যারা সবচেয়ে বেশি ট্যুরিজম, বিটিটিএফ-২০২৫ এর কাভারেজ এবং ট্যুরিজমের নতুন সব দিক উন্মোচন করবেন তাদের মধ্য থেকে সেরা ৩ জনকে নির্বাচন করে দেওয়া হবে বিশেষ পুরস্কার। পুরস্কারে থাকছে অ্যাওয়ার্ড, টোয়াবের সম্মাননা সার্টিফিকেট এবং দেশ-বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ।
যে কোনো দেশের ট্যুরিজমকে এগিয়ে নিয়ে যেতে দরকার দক্ষ ট্যুরিজম জনশক্তি। বাংলাদেশের প্রায় ১৬টি সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১টি বেসরকারি কলেজ ও একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। বিটিটিএফ এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নরত অবস্থায় ট্যুরিজমের সাথে সম্পৃক্ত করে সবার মাঝে ট্যুরিজমের হাতেকলমে অভিজ্ঞতা দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তার প্রথম ধাপ হিসেবে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবক এবং বিশ্ববিদ্যালয় দূত নির্বাচন করা হবে। যারা সরাসরি মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকবেন। এছাড়া, এসব প্রতিষ্ঠান থাকে নির্বাচিত বিশ্ববিদ্যালয় দূতদের পাস করে বের হওয়ার পর ট্যুরিজমে খাতে কাজ করার সুযোগ তৈরি করা হবে।
বিটিটিএফ মেলা কেবল বছরের একটি সময় ঢাকাকেন্দ্রিক না করে, বছরব্যাপী বাংলাদেশের বিভিন্ন টুরিস্ট জোনগুলোতে করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই মেলাগুলো বিটিটিএফ জোনাল মেলা হিসেবে পরিচিতি পাবে। খুলনা, সিলেট, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিভাগে ২০২৬ সালে এ আয়োজন করা হবে। লোকাল ট্যুর অপারেটর, ট্রাভেল এজেন্ট, স্থানীয় কারুশিল্প উদ্যোক্তা এবং অন্যান্য পর্যটন স্টেকহোল্ডার এসব মেলায় এক্সিবিউটর হিসেবে অংশগ্রহণ করবেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান সায়েমা শাহীন সুলতানা বলেন, বিটিটিএফ বাংলাদেশের পর্যটন খাতের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন। দেশের পর্যটনের বিকাশে এই আয়োজনের গুরুত্ব অনেক। সরকারের পক্ষ থেকে আমরা সবাই এ আয়োজনের সঙ্গে আছি এবং এই আয়োজনকে সফল করে তুলতে একসঙ্গে কাজ করব। আয়োজনের সার্বিক সফলতা কামনা করছি।
টোয়াবের সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান বলেন, টোয়াব বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্য সংগঠন এবং বিটিটিএফ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয় পর্যটন মেলা। পর্যটন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি এবং এর টেকসই উন্নয়ন এই মেলার প্রধান উদ্দেশ্য। আমরা আশা করছি যে, এবারের পর্যটন মেলা ব্যবসায়ী, দেশি-বিদেশি পর্যটক এবং পর্যটন শিল্প-সংশ্লিষ্ট সবার মাঝে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করবে। এই মেলা বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটাবে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
অনুষ্ঠানে টোয়াব বিভিন্ন অংশীদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একাধিক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে। এসব চুক্তির মাধ্যমে টেকসই পর্যটন, মেডিকেল ট্যুরিজম, ডিজিটাল প্রমোশন ও আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। টোয়াবের পার্টনার অ্যাসোসিয়েশন হিসেবে আরও যুক্ত আছে ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবন, ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজার, ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটা, রিসোর্ট ওনার অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবন, ই-ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং হাউজ বোট ওনার অ্যাসোসিয়েশন।
টোয়াব বিটিটিএফ ২০২৫ প্রেসমিট ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত আইজি মো. মাইনুল হাসান, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের উপ-পরিচালক (বিপণন ও ব্র্যান্ডিং) মহিবুল ইসলাম, বিটিটিএফ ২০২৫-এর গোল্ড স্পন্সর আইএইচজি সাউথ ওয়েস্ট এশিয়ার এরিয়া জেনারেল ম্যানেজার অশ্বিনী নায়ার, অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড ট্যুরিজম জার্নালিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশের (এটিজেএফবি) সভাপতি তানজিম আনোয়ার। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টোয়াবের প্রথম সহসভাপতি আবুল কালাম আজাদ, টোয়াবের সহসভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন, টোয়াবের সদ্য সাবেক সভাপতি শিবলুল আজম কোরেশী, টোয়াবের পরিচালক, বিটিটিএফ স্টিয়ারিং কমিটির কনেভনর ও সদস্য, টোয়াবের উপদেষ্টা, টোয়াবের সদস্য এবং টোয়াবের কোম্পানি সেক্রেটারি প্রমুখ।
মন্তব্য করুন