চলতি মাসের শুরুতে ভালোবেসে টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুরের বাসিন্দা মারুফা আক্তারকে বিয়ে করেন মিরসরাইয়ের সোনাপাহাড় এলাকার ট্রাকচালক আনিসুর রহমান। পরিবারের অমতে বিয়ে করায় মেনে নেয়নি বাবা-মা। স্ত্রীকে নিয়ে স্থানীয় মিঠাছরা বাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় ওঠেন। সবশেষ চারদিন আগে ছেলে এবং ছেলের বউকে অনুষ্ঠান করে ঘরে তুলে নেন বাবা-মা। হাতের মেহেদির রং মুছার আগেই বিধবা হয়ে গেলেন মারুফা আক্তার।
জানা গেছে, উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের মধ্যম সোনাপাহাড় এলাকার অলি আহম্মদ সওদাগর বাড়ির মোহাম্মদ রিয়াজ (১৮) একই এলাকার আবু তাহেরের ছেলে আনিসুর রহমান (২০), গণি আহম্মদ বাড়ির মৃত দিদারুল আলমের ছেলে মোহাম্মদ আরাফাত (১৭)। বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) রাত সাড়ে ৮টার দিকে ওই তিন বন্ধু রেললাইনের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। এ সময় ঢাকামুখী সোনার বাংলা ট্রেনের ধাক্কায় ঘটনাস্থলে তিন বন্ধুর মৃত্যু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী রায়হান উদ্দিন বলেন, ঢাকামুখী ট্রেনগুলো আপলাইন (ঢাকামুখী লেন) দিয়ে চলাচল করে। রিয়াজ, আরাফাত ও আনিস ডাউনলাইন (চট্টগ্রামমুখী লেন) দিয়ে উত্তরদিকে হেঁটে যাচ্ছিল। তাদের ১০-১৫ গজ দূরে ছিলাম আমি। আপলাইনের ট্রেনটি ডাউনলাইন (চট্টগ্রামমুখী লাইন) দিয়ে আসছে দেখতে পেয়ে আমি লাফ দিয়ে লাইনের বাহিরে চলে যাই। দুর্ঘটনার পর তাদের উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। একটি দুর্ঘটনায় এক সঙ্গে আমার তিন বন্ধুর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এমন মৃত্যু যেন আর কারও না আসে।
ট্রেনের ধাক্কায় মারা যাওয়া রিয়াজের মামা এনামুল হক বাবলু বলেন, সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল সে। তার আয় দিয়ে সংসার চলত। বৃহস্পতিবার রাতে তার মাকে বলে যায় যে, বেতন আনার জন্য কোম্পানিতে যাচ্ছে। কিন্তু বেতন নিয়ে আর আসা হল না। আসছে লাশ হয়ে। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে অসুস্থ বাবা-মা পাগলপ্রায়।
ট্রেনের ধাক্কায় মারা যান আনিসুর রহমান। তার বাবা আবু তাহের কালবেলাকে বলেন, ছেলে আমার নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছে মাত্র ২০ দিন আগে। এর মধ্যেই তার বউটা বিধবা হলো। আমি বউমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না। আল্লাহ কেন আমাকে এমন শাস্তি দিল। আমি কোনোভাবে বিষয়টি মানতে পারছি না। শুক্রবার সকালে মারুফার বাবা-মা এসে তাকে নিয়ে গেছে।
দুই বছর বয়সে মোহাম্মদ আরাফাতকে এতিম করে মারা যায় মা রোকসানা আক্তার। তখন থেকে আরাফাত সোনাপাহাড় এলাকায় নানার বাড়িতে থাকেন। নানার বাড়ির সকলের আদরযত্নে বড় হয় আরাফাত। গাড়ির সহকারী হিসেবে কাজ করতো আরাফাত। বৃহস্পতিবার রাতে বকেয়া বেতন এবং কাজে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়। যাওয়ার পথে ট্রেনের ধাক্কায় মারা যায় সে।
আরাফাতের মামা জামাল উদ্দিন বলেন, বোনের রেখে যাওয়া এতিম সন্তানকে বাঁচাতে পারলাম না। আরাফাতের মৃত্যু যেন একটি বংশের পরিসমাপ্তি। ট্রেনটি ডাউনলেনে পথে আসার কারণে দুর্ঘটনার শিকার। কারণ তারা যে লাইন দিয়ে হাঁটছে সে লাইনে তখন ট্রেন আসার কথা নয়। আসলেও ঢাকার দিক থেকে আসার কথা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টায় চার যুবক মোহাম্মদ রিয়াজ, আনিসুর রহমান, মোহাম্মদ আরাফাত ও মোহাম্মদ রায়হান সোনাপাহাড় এলাকায় রেললাইনের পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। এ সময় হঠাৎ ট্রেন এসে পড়লে রায়হান লাফ দিয়ে বাঁচলেও বাকি তিন বন্ধু ট্রেনের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই মারা যান।
মিরসরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক মোহাম্মদ এরশাদ উল্ল্যাহ বলেন, স্বজনরা হাসপাতালে তিনজনকে মৃত অবস্থায় নিয়ে আসে। পুলিশ আসার আগে নিহতদের প্রায় শতাধিক লোকজন তাদের নিয়ে চলে যায়। নিহতদের শরীরে বিশেষ করে মাথায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
সীতাকুন্ড রেলওয়ে থানার উপপরিদর্শক আশরাফ সিদ্দিকী কালবেলাকে বলেন, রেল লাইনের বড়তাকিয়া অংশে একটি কালভার্ট কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মিরসরাইয়ের কিছু অংশে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন আপ লাইনের পরিবর্তে ডাউন লাইনে চলছিল। ওই তিন যুবক ডাউন লাইন (চট্টগ্রাম লাইন) দিয়ে হাঁটছিল। ট্রেন আসার বিষয়টি তাদের খেয়াল ছিল না।
তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা সোনার বাংলা ট্রেনের ধাক্কায় তাদের মৃত্যু হয়। মরদেহ উদ্ধার করে পরিবারের লিখিত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়া পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়
আশরাফ সিদ্দিকী বলেন, ট্রেনের ধাক্কায় তিনজনের মৃত্যুর ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ, রেললাইনে এখন মানুষের অবৈধ অবস্থান। এখন রেললাইনে বসে মানুষ আড্ডা দেওয়া থেকে শুরু করে মুঠোফোনে গেমস খেলাসহ সবকিছুই করছে। এসব একেবারেই বেআইনি।
মন্তব্য করুন