বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ পৌষ ১৪৩২
স্বপন চন্দ্র দাস, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৮ জুন ২০২৫, ০৫:৩৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

বাড়ছে পানি, ভাঙনে বিপর্যস্ত যমুনাপাড়ের মানুষ

ভয়ংকর গর্জনে তীরে আছড়ে পড়ছে উত্তাল ঢেউ। ঢেউয়ের ধাক্কায় ভেসে যাচ্ছে ফসলি জমি। ছবি : কালবেলা
ভয়ংকর গর্জনে তীরে আছড়ে পড়ছে উত্তাল ঢেউ। ঢেউয়ের ধাক্কায় ভেসে যাচ্ছে ফসলি জমি। ছবি : কালবেলা

শুরু হয়েছে বর্ষা মৌসুম। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারি বৃষ্টিপাতে প্রমত্তা যমুনায় দ্রুতগতিতে বাড়ছে পানি। নতুন পানিতে ফুলে-ফেঁপে উঠছে যমুনা নদী। ভয়ংকর গর্জনে তীরে আছড়ে পড়ছে উত্তাল ঢেউ। ঢেউয়ের ধাক্কায় ভেসে যাচ্ছে মোহাম্মদ আলীর ক্ষেতের আখ। কয়েক দিনে আখক্ষেতটির সিংহভাগ গিলে নিয়েছে রাক্ষসী এ যমুনা। যেটুকু আছে সেটুকুও রক্ষা সম্ভব হবে না জেনে অপরিপক্ব আখ কেটে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার পার পাঁচিল গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ আলী ও তার ভাইদের ৪০ বিঘার মতো জমি ছিল। দফায় দফায় ভাঙনে ২৫ বিঘা বিলীন হয়েছে। বাকি জমিতে ফসলাদি চাষ করে কয়েকটি পরিবার জীবিকা নির্বাহ করে। মোহাম্মদ আলী বলেন, দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে তার আখগুলো পরিপক্ব হয়ে যেত। কিন্তু এত কষ্টের আখক্ষেত কয়েকদিনেই গিলে নিল যমুনা নদী। যমুনার এমন ভয়ংকর তাণ্ডবে মোহাম্মদ আলীর মতো সিরাজগঞ্জের নদী তীরবর্তী অঞ্চলের অসংখ্য মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, সদর উপজেলার ছোনগাছা ও খোকশাবাড়ি ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামেই চলছে ভাঙন। যমুনায় পানি দ্রুত বাড়তে থাকায় ভাঙনের তীব্রতা বেড়ে গেছে। বালুভর্তি জিওব্যাগ ডাম্পিং করেও ভাঙনরোধ হচ্ছে না।

স্থানীয়রা জানান, মাসখানেক ধরেই এ অঞ্চলে ভাঙন দেখা দিয়েছে। তবে এক সপ্তাহ ধরে পানি বাড়তে থাকায় ভাটপিয়ারী, পার পাঁচিল, ব্রাহ্মণ বয়রা ও পাঁচঠাকুরী গ্রামের তীরবর্তী অঞ্চলে ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়েছে। আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন এসব অঞ্চলের মানুষরা।

ভাটপিয়ারী গ্রামের আব্দুর রউফ রতন বলেন, আমার বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে রয়েছে যমুনা। রাতে ঘুমাতে পারি না। প্রতি রাতেই ভাঙন আতঙ্কে থাকি। কখন যেন নদী ধেয়ে আসে বাড়ির দিকে।

জামাল উদ্দিন শেখ বলেন, ভাঙন ঠেকাতে বালুর বস্তা ফেলা হলেও কাজে আসছে না। যেভাবে নদী ভাঙছে বালুর বস্তাও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

আব্দুল হামিদ ও হাবিবুর রহমান বলেন, দফায় দফায় নদী ভাঙনে আমরা অসহায়। বহুবার ভাঙনের শিকার হয়েছি। বাপ-দাদার সম্পত্তি বিলীন হয়েছে। এখন যেটুকুর উপর বাড়ি করে রয়েছি, সেটাও ভাঙনের মুখে। এটা ভেঙে গেলে আমরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাব।

ভাটপিয়ারী গ্রামের মিনা খাতুন বলেন, সাতবার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছি। নিজেদের বাড়িঘর তো সব আগেই যমুনায় গেছে। এখন সরকারি জায়গায় থাকি, সেটাও ভাঙনের মুখে রয়েছে।

ভাটপিয়ারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা সুরাইয়া খাতুন বলেন, এ স্কুল ভবনের স্থান দফায় দফায় পরিবর্তন করা হয়েছে। গত এপ্রিল মাসে বিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণ হয়েছে। নদী থেকে খুব সামান্যই দূরে রয়েছে ভবনটি। বাঁধ ভাঙলেই স্কুল গিলে নেবে যমুনা। এতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় আবারও ব্যাঘাত ঘটবে।

সদর ছাড়াও চৌহালী উপজেলার স্থল, সদিয়া চাঁদপুর ও উমারপুর এবং শাহজাদপুর উপজেলার সোনাতনী, গালা ও কৈজুরী ইউনিয়নের অন্তত ২৫-৩০টি গ্রামে শুরু হয়েছে তীব্র ভাঙন। এসব উপজেলার শতাধিক বাড়িঘর, ৫০০ বিঘারও বেশি ফসলি জমি, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নদীতে বিলীন হয়েছে। ভাঙনের মুখে রয়েছে বাড়িঘর, কৃষি জমি ও অসংখ্য প্রতিষ্ঠান।

স্থল ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মনিরুল ইসলাম বলেন, নয়াপাড়া গ্রামে কয়েক দিন ধরে ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙনের তীব্রতা খুব বেশি। ইতোমধ্যে গ্রামের অর্ধশত বিঘা ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। প্রাইমারি স্কুল, হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও মসজিদ থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরে রয়েছে নদী।

একই ইউনিয়নের রইচ উদ্দিন মেম্বার বলেন, চালুহারা কুড়াগাছা এলাকাতেও তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। কুড়াগাছার একটি স্কুল নদীগর্ভে গেছে। তেঘরি প্রাইমারি স্কুলটি যে কোনো সময় যমুনায় বিলীন হতে পারে। এসব এলাকার বেশ কিছু বাড়িঘরও নদীতে গেছে।

সঁদিয়া চাঁদপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য হারান আলী বলেন, বারবেলা কবরস্থানের সামনে নদীভাঙন শুরু হয়েছে। কয়েক দিন আগে যেখানে স্কুলঘর স্থাপন করা হয়েছিল সেখানে ভাঙন শুরু হয়েছে। এ ছাড়াও ইউনিয়নের বোয়ালকান্দি, গাড়াবাড়ী, রসুলপুর, মৌহালী, ইজারাপাড়া, বারবেলা, গ্রামের অন্তত পাঁচ শতাধিক জমি ফসলসহ নদীগর্ভে গেছে। এসব গ্রামের শতাধিক বাড়িঘরও বিলীন হয়েছে।

চৌহালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের তিনটি ইউনিয়নে ভাঙন শুরু হয়েছে। উমারপুরে একটু বেশি ভেঙেছে। আমরা ইতোমধ্যে ভাঙন কবলিতের জন্য চার টন চাল বরাদ্দ দিয়েছি। যাদের বাড়ি ভেঙে গেছে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস দিয়ে আবেদন করলে ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে যতটুকু সম্ভব ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, আমাদের কৈজুরী ও সোনাতনী ইউনিয়নে কিছু ভাঙন রয়েছে। আমরা ভাঙন কবলিতদের জন্য উপজেলা পরিষদ থেকে সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছি।

এদিকে গত দুদিন ধরে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে যমুনার পানি। শুক্রবার (২৭ জুন) সকালে যমুনা নদীর সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্টে পানির সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ১১ দশমিক ৩২ মিটার। ২৪ ঘণ্টায় ৪১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ১ দশমিক ৫৮ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ পয়েন্টে বৃহস্পতিবার ৪৪ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পায়।

অপরদিকে জেলার কাজিপুর মেঘাই পয়েন্টে পানির সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ১৩ মিটার। ২৪ ঘণ্টা ৩২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ১ দশমিক ৮০ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ পয়েন্টে বৃহস্পতিবার ৪৮ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পায়।

সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেসুর রহমান বলেন, বর্তমানে যমুনার পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সেটি ডেঞ্জার লেভেল ক্রস করবে না। আশা করছি দু-তিন দিন পর পানি কমে যাবে। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু এলাকায় ভাঙন প্রবণ হয়ে উঠেছে। যেমন ভাটপিয়ারী ও কৈজুরী এলাকা।

তিনি আরও বলেন, যে এলাকাগুলো আমাদের মেইনল্যান্ডের সঙ্গে সেখানে জরুরিভাবে কাজ করছি। আমাদের বাঁধ কোথাও সমস্যা হলে আমরা সেখানে কাজ করছি। নদীর চরের কিছু কিছু এলাকায় ভাঙন আছে- শাহজাদপুর ও চৌহালীতে। চরে আসলে কাজ করার সুযোগ নেই।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গণতন্ত্র হারাল এক অভিভাবক, জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি : এবিএম ওবায়দুল

প্রকৌশল খাতে খালেদা জিয়ার অবদান অনস্বীকার্য : আইইবি

রুমিন ফারহানাসহ যে ৯ জনকে বহিষ্কার করল বিএনপি

খালেদা জিয়ার জানাজা উপলক্ষে যেসব সড়ক বন্ধ থাকবে 

বেগম খালেদা জিয়ার জানাজায় নারীদের অংশগ্রহণ নিয়ে যা জানা গেল

বহিষ্কারের পর নির্বাচন করার ঘোষণা ১ বিএনপি নেতার

ইজতেমার ময়দানে সমাবেশ নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত জানাল সরকার

রাস্তায় ফেলে যাওয়া ২ শিশুর দায়িত্ব নিলেন জেলা প্রশাসক

খালেদা জিয়ার মৃত্যু / ৩ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণায় স্থগিত হলো যেসব পরীক্ষা

বিএনপি নেতার প্রার্থিতা গ্রহণ না করতে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে ব্যাংকের চিঠি

১০

খালেদা জিয়ার ‘মাতৃস্নেহ’ নিয়ে অধ্যাপক জাহিদের স্মৃতিচারণা

১১

খালেদা জিয়ার জানাজায় অংশ নিতে ঢাবির বিশেষ পরিবহন ব্যবস্থা

১২

ওয়েস্টিন, শেরাটন ও হানসার ৩১ ডিসেম্বরের সব অনুষ্ঠান বাতিল

১৩

বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের প্রতীক : ডা. তাহের

১৪

খালেদা জিয়ার জানাজায় নারীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা

১৫

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বিশ্বনেতাদের শোকবার্তা

১৬

যে পথে সংসদ ভবনে যাবে খালেদা জিয়ার লাশবাহী কনভয়

১৭

খালেদা জিয়া ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন : সমমনা জোট

১৮

বুধবার সাধারণ ছুটি যারা পাবেন না

১৯

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বরিশালে কোরআন খতম ও দোয়া

২০
X