বিশ্বাস রক্ষায় জীবন দিয়ে হলেও প্রভুভক্তি দেখিয়ে গেলেন চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের উত্তম বর্মণ (৭০) ও কাজলী রানী বর্মণ (৫০)। এতে করে সহানুভূতিময় মানবিকতা পেলে যে কেউ নিজের সবটা দিয়ে দিতে পারে, সেই দৃষ্টান্তই স্থাপিত হলো।
শুক্রবার (৮ সেপ্টেম্বর) হাজীগঞ্জের ৬ নম্বর বড়কুল ইউনিয়নের কালাসীতার বাড়িতে এক বৃদ্ধ দম্পতির মরদেহ উদ্ধার শেষে কালবেলাকে এমনটিই জানিয়েছে পিবিআই।
স্থানীয় সবিতা সাহা ও পুলিশ সূত্র জানায়, উত্তম বর্মণ হচ্ছেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী দাস গোত্রের। অর্থাৎ এই বর্মণ টাইটেলের হিন্দুরা সাধারণত মাছ বিক্রি করে সংসার চালিয়ে থাকেন। উত্তমও এর ব্যতিক্রম নয়। অসহায় হলেও তার সততার কাছে ভালোবাসার বন্ধনে বাঁধা পড়েন বড়কুলের স্থানীয় ব্যবসায়ী দুলাল সাহা। যিনি পরিবারসহ ব্যবসায়িক কাজে বছরের বেশিরভাগ সময় নারায়ণগঞ্জে বসবাস করেন।
পুলিশ সূত্রে আরও জানা যায়, উত্তম বর্মণ প্রায় ৩০ বছর পূর্বে তার প্রথম স্ত্রী মিলনী রানি বর্মণকে হারিয়েছেন। সে ঘরে তার এক মেয়ে রিনা রানিকে মতলব দক্ষিণে এবং আরেক মেয়ে বিনা রানিকে শরীয়তপুরে বিয়ে দেন। অসহায় উত্তম তখন নিজের দেখভালের জন্য কাজলী রানিকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সে ঘরে একটি সন্তান হলেও এক সময় সেই সন্তানও মারা যায়। পরে মাছ ব্যবসার পাশাপাশি বাড়তি আয় হিসেবে পার্শ্ববর্তী দুলাল সাহার বাড়িতে কেয়ারটেকার হিসেবে কাজ করতেন। গেল প্রায় ৮ বছর যাবৎ উত্তম একা কেয়ারটেকারের কাজ করে বিশ্বাস অর্জন করায় প্রায় ৩ বছর পূর্বে তার স্ত্রী কাজলী রানিকেও তার সঙ্গে দুলাল সাহার বাড়িতে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। আর মনিবের অর্থাৎ প্রভুর এমন মানবিক দয়ায় আবেগ আপ্লুত এই দম্পতি নিজের জীবন দিয়ে হলেও সে বিশ্বাস টিকিয়ে রেখে গেছেন।
দুলাল সাহা বলেন, আমার এখানে এক তলা বিল্ডিংয়ে ৩টি কক্ষ রয়েছে। তার এক কক্ষে উত্তম ও কাজলী দম্পতিকে থাকতে দিয়েছি। মূলত ওনাদের সততার প্রতি আমার অগাধ বিশ্বাস ছিল বলেই আমি ওনাদের আপন করে নিয়েছিলাম। আমি পূজা পার্বন হলে মাঝে মাঝে এখানে আসতাম। এর মধ্যে যে এই দুর্ঘটনা ঘটবে তা কল্পনাও করতে পারিনি। আমি ঘটনায় জড়িত যে বা যারা তাদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
মৃত উত্তম বর্মণের মেয়ে রিনা রানি বর্মণ বলেন, বাবা গেল ৩ থেকে ৪ মাস যাবৎ পা ভেঙে পঙ্গু অবস্থায় এই কক্ষে পড়ে ছিল। খুব অসহায়ত্বের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছিলেন। তবুও মনিবের কাজে কোনো অনীহা ছিল না তার। কারও সঙ্গে কোনো শত্রুতাও তার ছিল না। কেন তাদের হত্যা করা হলো, আমরা এর বিচার চাই।
এ বিষয়ে পিবিআই চাঁদপুরের ইন্সপেক্টর এম শামীম আহমেদ বলেন, বৃদ্ধ ওই দম্পতির মরদেহ হাত-পা বাঁধা ও বীভৎস অবস্থায় পেয়েছি। ওনাদের দুজনকে দুটি পৃথক কক্ষে পেয়েছি। পূর্ব পাশের কক্ষের পেছনে খাল পাড় ছিল। সেখান দিয়েই দুর্বৃত্তরা এসে জানালার ৬টি গ্রিল কেটে ঘরে প্রবেশের স্থান তৈরি করে। আমরা ভবনের কক্ষের আলমারিসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র অগোছালো পেয়েছি। হয়তো যারা ঘরে ঢুকেছিল, তারা তাদের দেখে ফেলায় ওরা আতঙ্কিত হয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ধারণা করছি, ওগুলো রক্ষা করতেই ওই দম্পতিকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। তদন্ত কাজ শেষে বিস্তারিত বলা যাবে।
এ বিষয়ে হাজীগঞ্জের ৬ নম্বর বড়কুল ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মজিব বলেন, এলাকায় চোর ডাকাতির ঘটনা বেড়ে চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অনুরোধ করব, এই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করে দোষিদের খুঁজে বের করে দ্রুত আইনের আওতায় আনুন।
মন্তব্য করুন