গাজীপুর মহানগরীর গাছা এলাকায় বিদ্যালয়ের মাঠে ‘গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প পণ্য মেলা’র নামে চলছে অভিনব প্রতারণা ও লটারির বাণিজ্য। সরকারি লোগোযুক্ত পুলিশের ব্যানার টাঙিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টিকিট বিক্রির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে আয়োজকদের বিরুদ্ধে। বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর ভেঙে বসানো হয়েছে টিকিট বিক্রির কাউন্টার।
এতে গাছা উচ্চ বিদ্যালয়, গাছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং আইউব আলী বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা মাঠে খেলাধুলা, অ্যাসেম্বলি বা ক্লাস কার্যক্রম করতে পারছে না। শিক্ষার্থীরা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে মেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে আর খেলছে দোলনায়।
স্থানীয় বাসিন্দা ও শিক্ষকরা জানান, গাছা উচ্চ বিদ্যালয়ের বড় মাঠে এক মাসব্যাপী এই মেলার আয়োজন করে বাংলাদেশ বেনারসি মসলিন এন্ড জামদানি সোসাইটির সভাপতি এম এ মাঈন খান ওরফে বাবুল নামের এক ব্যবসায়ী। যদিও মেলার নাম দেওয়া হয়েছে গ্রামীণ ও কুটিরশিল্প পণ্য মেলা, বাস্তবে এখানে মূল আকর্ষণ লটারি। ২০ টাকা মূল্যের লটারি টিকিটের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা তুলছে চক্রটি।
সোমবার (০১ সেপ্টেম্বর) সকালে সরেজমিনে বিদ্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, গাছা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. হারুনুর রশিদ বলেন, ‘পুলিশ প্রশাসন যদি অনুমোদন দেয়, তবে আমাদের করার কিছুই নেই।’ একইদিন দুপুরে গাছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাছনারা সিদ্দিকা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, ‘আমাদের স্কুলের নিজস্ব মাঠ নেই। তাই এই মাঠেই প্রতিদিন অ্যাসেম্বলি হতো। কিন্তু মেলার কারণে টিনের বেড়া দেওয়ায় এখন বারান্দায় অ্যাসেম্বলি করতে হচ্ছে।’
মেলার শুরু থেকে টিকিট কিনে আসছেন এলাকার শ্রমিকরা। সোমবার দুপুরে স্থানীয় একটি কারখানার শ্রমিক লিয়াকত শিকদার প্রতারণার অভিযোগ তুলে বলেন, ‘প্রতিদিন পাঁচটি টিকিট কিনছি, কিন্তু এখনো কিছুই পাইনি। দুই-আড়াই হাজার টাকা দিয়ে দিয়েছি।’
আরেক শ্রমিক নুরুল ইসলাম অভিমান ঝেড়ে বলেন, ‘মেলায় যারা লটারি জেতে তারা আয়োজকদের লোক। সাধারণ মানুষ জেতার সুযোগ পায় না।’
মেলার ভেতরে সোমবার বেলা ১১টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, ভেতরে প্রবেশ করতে হলে কিনতে হচ্ছে টিকিট। টিকিট কেটে প্রবেশ করলে চোখে পড়ে কয়েকটি দোলনা, খাবারের দোকান আর খেলনার স্টল। এক কোণায় সাজানো রয়েছে লটারির মঞ্চ, সেখানে প্রদর্শিত হচ্ছে আকর্ষণীয় পুরস্কার। তবে মাঠে কোথাও গ্রামীণ শিল্প বা কুটির শিল্পের পণ্য নেই। এ সময় টিকিট বিক্রেতা আশরাফুল বলেন, ‘প্রায় দেড়শ অটোরিকশা প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে এই লটারি টিকিট বিক্রি করছে।’
প্রথমদিকে মেলার মূল ফটকে ব্যানার টাঙানো ছিল যেখানে লেখা ছিল—‘গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের অনুমতি ও সার্বিক সহযোগিতায় এই মেলার আয়োজন করা হয়েছে।’ তবে গত রোববার (৩১ আগস্ট) রাতে সেটি সরিয়ে ফেলা হয়। স্থানীয়রা বলছেন, জেলা প্রশাসক মেলা বন্ধের নোটিশ দিলেও পুলিশ প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। প্রশাসনের এই দ্বন্দ্বও সামনে এসেছে।
এ বিষয়ে গাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আমিনুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘কমিশনার অনুমোদন দিয়েছেন, মেলা চলবে মাসব্যাপী।’ অন্যদিকে গাজীপুর জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফীন রোববার রাতে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা অনুমোদন দিইনি। পরে পুলিশ নিজ উদ্যোগে অনুমতি দিয়েছে। বিষয়টি জেলা কোর কমিটিতেও আলোচিত হয়েছে।’
এদিকে জেলা প্রশাসন ও পুলিশের মধ্যে ঠেলাঠেলির কারণে মেলার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, পুলিশের ছত্রছায়াতেই প্রতিদিন চলছে লটারির নামে প্রতারণা। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের নীরব ভূমিকা ও যোগসাজশের কারণেই সাধারণ মানুষ প্রতারিত হচ্ছে।
স্থানীয়দের দাবি, বিদ্যালয়ের মাঠ দখল করে প্রতারণামূলক এই মেলা দ্রুত বন্ধ করা হোক এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
মন্তব্য করুন