রেজওয়ান রনি, রংপুর
প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২৫, ১০:০৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
শ্যামপুর চিনিকল

মিলের যন্ত্রপাতিতে মরিচা, কাগজেই আটকে আছে চালুর ঘোষণা

শ্যামপুর চিনিকল, রংপুর। ছবি : কালবেলা
শ্যামপুর চিনিকল, রংপুর। ছবি : কালবেলা

সকালের কুয়াশা ভেদ করে আখবোঝাই ট্রাকের সারি আসত মিলের গেটে। হাজারো শ্রমিকের কর্মচাঞ্চল্যে মুখর থাকত চিনিকল। কৃষক, শ্রমিক ও স্থানীয় মানুষের জীবিকার এই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেছে পাঁচ বছর আগে।

৯ মাস আগে মিলটি ফের চালুর ঘোষণা এলেও এখনো বন্ধই পড়ে আছে রংপুরের একমাত্র ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান—শ্যামপুর চিনিকল। চিনিকলটি ফের চালুর জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। কমিটি বন্ধ মিলগুলো চালুর সুপারিশ করেছিল।

টাস্কফোর্সের সুপারিশ অনুযায়ী, শিল্প মন্ত্রণালয় ৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ছাড়ের জন্য অর্থ বিভাগে চিঠি পাঠায়। অর্থ বরাদ্দ পেলে মিলটি চালুর কথা ছিল। কিন্তু অর্থ বিভাগ অনাস্থা জানানোয় সে উদ্যোগ থেমে যায়।

শ্যামপুর সুগার মিল সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৪ সালে ১১১ একর জমির ওপর এই মিল প্রতিষ্ঠিত হয়। উৎপাদন শুরু হয় প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মধ্যে। প্রথমদিকে মুনাফা করলেও ২০০০ সালের পর থেকে মিলটি ক্রমাগত লোকসানে পড়ে। দৈনিক ১ হাজার ১৬ টন আখ মাড়াই ও বার্ষিক ১০ হাজার ১৬১ টন চিনি উৎপাদনক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও শেষ দশ বছরে প্রায় ৩৬৫ কোটি টাকা লোকসান হয়। পরবর্তী সময়ে শিল্প, বাণিজ্য, অর্থ ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি মাড়াই কার্যক্রম বন্ধের সুপারিশ করে। এরপর ২০২০-২১ মাড়াই মৌসুমে মিলটি বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত বছরের ১৫ নভেম্বর শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ৬টি বন্ধ রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকল ফের চালুর আশ্বাস দেন। তিনি জানান, একটি টাস্কফোর্স গঠন করে কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

পরবর্তী সময়ে ডিসেম্বর মাসে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, পর্যাপ্ত আখ পাওয়া গেলে শ্যামপুর চিনিকলে ফের মাড়াই কার্যক্রম শুরু করা হবে। এজন্য ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আখ চাষ ও রোপণের সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। সেই হিসাবে ফেব্রুয়ারি মাসে শিল্প মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ বিভাগে ৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ছাড়ের জন্য চিঠি পাঠানো হয়। পরে জুলাই মাসে ফের ২০২৪-২৫ ও ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য অর্থ মঞ্জুরের অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু ৩০ জুলাই অর্থ বিভাগ চিঠির মাধ্যমে বরাদ্দ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানায়। ফলে নতুন মাড়াই মৌসুম শুরু হলেও মিলটি বন্ধই রয়েছে।

সম্প্রতি শ্যামপুর চিনিকল ঘুরে দেখা যায়, কর্মচাঞ্চল্যে ভরা মিলটি এখন নিস্তব্ধ। চারপাশ জঙ্গলাকীর্ণ। আখ পরিবহনের ট্রাক্টর ও ট্রলিগুলো পড়ে আছে অযত্নে। যন্ত্রপাতিগুলোও দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকায় ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে।

টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য আলতাফ হোসেন বলেন, ‘৬টি বন্ধ মিলের মধ্যে প্রথমে শ্যামপুর ও সেতাবগঞ্জ চিনিকল চালুর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কৃষকদের আখ চাষে উৎসাহ দিতে হবে এবং আখের উপজাত দিয়ে নতুন শিল্প গড়ে তুলতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠান চালাতে চিনিকলের কাছে জমি ও জনবল দুটোই রয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘চিনিকলগুলো নিজেরা বাজার নির্ধারণ করতে পারে না। উৎপাদন ব্যয় ও বিক্রয়মূল্যের মধ্যে যে ‘ট্রেড গ্যাপ’ তৈরি হয়, সেই ঘাটতি পূরণে সরকার সহায়তা করলে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ সম্ভব হবে।’

চিনিকল বন্ধ হওয়ার পর কৃষক, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা সংকটে পড়েছেন। অনেকে আখ চাষ ছেড়ে অন্য ফসলে ঝুঁকেছেন, কিন্তু লাভজনক হয়নি।

গোপালপুরের কৃষক আকতারুল ইসলাম বলেন, ‘মিল বন্ধ হওয়ার পর এক বছর আখ চাষ করেছিলাম। এখন ধান-পাট করি, তেমন লাভ হয় না।’

আরেক কৃষক শফিকুল মুন্সী বলেন, ‘এই এলাকার বেশিরভাগ মানুষ আখ চাষ করত। এখন ধান আবাদ করে অনেকে লোকসানে পড়েছে। মিল চালু হলে আমাদের জন্য ভালো হতো।’ দীর্ঘদিন কাজ না থাকায় শ্রমিকদের অনেকেই পেশা পরিবর্তন করেছেন। শিবপুর এলাকার আবুল হোসেন বলেন, ‘আগে মিলের কাজ নিয়ে চিন্তা করতে হতো না। এখন দিনমজুর হিসেবে কাজ করি, ঢাকায় গিয়ে রিকশা চালাতে হয়।’

আউলিয়াগঞ্জের খোরশেদ আলম মিল চালু থাকা অবস্থায় ভ্রাম্যমাণ দোকান চালাতেন। তিনি বলেন, ‘আগে সংসার চালাতে কষ্ট হতো না, এখন অনেক কষ্ট করে চলে।’

রংপুর কৃষক সংগ্রাম পরিষদ দ্রুত মিল চালুর দাবি জানিয়েছে। সংগঠনের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট পলাশ কান্তি নাগ বলেন, ‘শ্যামপুর সুগার মিল বন্ধ হওয়ায় হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে গেছে। রংপুরকে দেশের এক নম্বর জেলা করার ঘোষণাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে এ মিলটি দ্রুত চালু করতে হবে।’

মিল সূত্রে জানা গেছে, চালু অবস্থায় ৪৯৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে ৬৪ জন কর্মরত রয়েছেন।

মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘অর্থ ছাড়ের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে না বলা হয়েছে। আমাদের চেয়ারম্যান ও পরিচালক চেষ্টা করছেন। তবে সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার জানা নেই।’

তিনি জানান, বর্তমানে ৬৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে মিলের দাপ্তরিক কার্যক্রম চলছে। সবাই নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এনসিপির কার্যালয়ের সামনে ককটেল নিক্ষেপ

জামিনে বেরিয়ে সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা, ছাত্রলীগ নেতা গ্রেপ্তার

প্লট বা ফ্ল্যাট হস্তান্তরে কারও অনুমতি লাগবে না : গণপূর্ত মন্ত্রণালয়

কুড়ির এশিয়ান কাপে সঙ্গী চীন

প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্দোলন প্রত্যাহার

বন্দর ও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মাশুল নিয়ে দর-কষাকষি চলছে : নৌ উপদেষ্টা

দিল্লিতে বিস্ফোরণের আগে ‘রহস্যময়’ অভিযান, যা জানা গেল

দেশ কীভাবে পরিচালিত হবে ৩১ দফায় সবই রয়েছে : হারুনুর রশিদ

কর্মজীবী নারীদের নতুন প্রস্তাব দিলেন জামায়াত আমির

আমিনুলের ঘোষণায় শুরু হচ্ছে বিসিবির নতুন যুগ

১০

হামিমের উদ্যোগে তারেক রহমানের জন্মদিনে ফ্রি মেডিকেল ক‍্যাম্প

১১

দিল্লি কাঁপানো ৩৭ মিনিট, কী ঘটেছিল

১২

বার্সাকে না জানিয়েই ক্যাম্প ন্যু’তে ফিরেন মেসি!

১৩

নির্ধারিত সময়েই এমপিওভুক্ত করতে হবে : সেলিম ভুঁইয়া

১৪

‘জয় বাংলা’ বলা অপরাধ হলে আমাকে গ্রেপ্তার করুন : কাদের সিদ্দিকী

১৫

ডাবল মার্ডারের ঘটনায় রিফাত বাহিনীর প্রধান অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার

১৬

দিল্লিতে বিস্ফোরণ : মুম্বাই ও উত্তরপ্রদেশে জারি উচ্চ সতর্কতা

১৭

শ্যামপুর চিনিকল / মিলের যন্ত্রপাতিতে মরিচা, কাগজেই আটকে আছে চালুর ঘোষণা

১৮

জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরের বিকল্প নেই : আমির খসরু

১৯

পর্যটকদের অসচেতন আচরণে লাল কাঁকড়া বিপন্ন হচ্ছে কুয়াকাটা সৈকতে

২০
X