

স্রষ্টার বৈচিত্র্যময় সৃষ্টির সমাহার এ পৃথিবীকে রঙিন ও প্রাণবন্ত করে রেখেছে। এসব সুন্দর সৃষ্টির মধ্যে অনিন্দ্যসুন্দর সৃষ্টি রংবাহারি প্রজাপতি। প্রকৃতি ঘিরে প্রজাপতির ওড়াউড়ির দৃশ্য দেখতে কার না ভালো লাগে। এটি সত্যিই একটি চোখজুড়ানো সুন্দর দৃশ্য। এ মনোরম দৃশ্যে প্রকৃতি আরও বেশি দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে। প্রকৃতি ও প্রজাপতির নিবিড় সম্পর্কে প্রকৃতিতে এক স্বর্গীয় আবহ তৈরি হয়।
এমনই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখা গেছে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার কুমিল্লা-মিরপুর সড়কের পাশে। সড়কের পাশের ঝোপ ঘিরে বাদামি রঙের কয়েকটি জংলাবিড়া প্রজাপতির নকশাখচিত ডানার ওড়াউড়িতে প্রকৃতি যেন রঙিন হয়ে উঠেছিল।
প্রজাপতিগুলো উড়ে উড়ে বসছিল এ গাছের পাতা থেকে ও গাছের পাতায়। বসছিল ঝোপের পাশের শ্যাওলাযুক্ত সীমানাপ্রচীরে। আবারও উড়ছিল, আবার বসছিল। এদের এমন মনোমুগ্ধকর ওড়াউড়িতে চোখ আটকে গিয়েছিল। এদের ডানার রঙিন আলপনা অবাক করার মতো সুন্দর। এ দৃশ্য ছিল মন কেড়ে নেওয়ার মতো সুন্দর।
মাইক্যালেসিস পারসিয়াস বৈজ্ঞানিক নামের জংলাবিড়া প্রজাপতি একপ্রকার গাঢ় বাদামি বর্ণের প্রজাপতি। এটি লিমফ্যালিডি গোত্রের স্যাটাইরিনি উপগোত্রের অন্তর্ভুক্ত। এদের শরীরের রঙের কারণে এটিকে বুশব্রাউন বলে অভিহিত করা হয়। এদের পায়ের নিম্নতলে দৃঢ় রোঁয়া থাকে। এসব প্রজাপতি খুব ভালো উড়তে পারে না। এরা সাধারণত উজ্জ্বল আলোময় পরিবেশ এড়িয়ে চলে। ১৯৭৫ সালে প্রথম এই প্রজাপতি শনাক্ত করা হয়। এর বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন ডেনমার্কের পোকাবিশারদ জন ক্রিস্টিয়ান ফ্যাবরিসিয়াস।
এ প্রজাতির প্রজাপতি ভারতীয় উপদ্বীপ, মধ্য ও পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, পশ্চিমবঙ্গ, হিমাচল প্রদেশ থেকে সিকিম হয়ে অরুণাচল প্রদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মায়ানমার, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া যায়।
জংলাবিড়া প্রজাতির সঙ্গে যে তিনটি বুশব্রাউন প্রজাপতিকে গুলিয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকে সেগুলো হলো, খয়রাবিড়া, তাঁতরাবিরা ও হোয়াইট-লাইন বুশব্রাউন। আপাত দৃষ্টিতে চারটি প্রজাপতির ডানার নিম্নতল প্রায় একইরকম দেখতে হলেও জংলাবিড়া বাদে বাকি তিনটির পেছনের ডানার চক্ষুবিন্দুর সারিতে শেষ চারটি চক্ষুবিন্দু একই সরলরেখায় অবস্থান করে, কিন্তু জংলাবিড়ার ক্ষেত্রে একই সরলরেখায় অবস্থান করে না। চার নম্বর চোখটি একটু বাইরের দিকে ঘেঁষে অবস্থিত।
জংলাবিড়া প্রজাপতির ডানা প্রসারিত অবস্থায় ৩৮-৫৫ মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের হয়। এ প্রজাপতির ডানার উপরিতল কালচে বা কালচে বাদামি অথবা বাদামি খয়েরি হয়ে থাকে। সামনের ডানায় ২নং শিরামধ্যে একটি সাদা তারাবিন্দু যুক্ত। কালচে খয়েরি বা কালো চন্দ্রবিন্দু যেটি হালকা হলদে বাদামি বলয় দ্বারা আবৃত। স্ত্রী প্রজাপতির চন্দ্রবিন্দুটি পুরুষ প্রজাপতির অপেক্ষায় বৃহত্তর। স্ত্রী-পুরুষ প্রকার অনুরূপ। শুঙ্গ বাদামি, কালো ডোরাযুক্ত। শীর্ষভাগ কালো বা কালচে বাদামি ও তার নিচে খানিক হলুদের ছাপযুক্ত। মাথা, বক্ষদেশ ও উদর উভয়পৃষ্ঠই বাদামি বা কালচে বাদামি। ডানার নিম্নতল বাদামি, কমবেশি হালকা বেগুনির ছোঁয়াযুক্ত ও কালচে বাদামি ছোট ছোট তীর্যক সরু দাগে ছাওয়া।
এ প্রজাপতি উড়ার ক্ষেত্রে দুর্বল। এরা ধীরস্থিরভাবে ওড়ে। খুব বেশি উপরে ওঠে না। এরা উড়ার সময় ডানায় ঝাঁকি দিতে দিতে ওড়ে। এরা মাটির কাছাকাছি থেকেই ওড়াউড়ি করে। এরা গাছের পাতায়, ডালে বা মাটিতে বসে থেকে হঠাৎ অন্য কোনো পুরুষ প্রকারকে ধাওয়া করতে প্রায়শই দেখা যায়। একটি স্ত্রী প্রজাপতির পেছনে কয়েকটি পুরুষ প্রজাপতি উড়ে বেড়ায়। আবার কখনো অনেকগুলো প্রজাপতি একসঙ্গে গোল হয়ে উড়ে বেড়ায়।
প্রজাপতি গাছপালা ছাওয়া ঝোপঝাড়ের আশপাশে অবস্থান করে। এদের বিশেষ করে আমবাগান ও বাঁশবাগানের কাছাকাছি ঝোপঝাড় বেশি পছন্দ। এ ছাড়া অন্যান্য ঝোপঝাড় ও জংলা পরিবেশেও এদের উপস্থিতি দেখা যায়। এরা হামেশাই সকালের দিকে গাছের পাতা, ডাল বা কাণ্ডে বসে রোদ পোহায়। ডানা বন্ধ অবস্থায় এই প্রজাপতিরা রোদ পোহায়। ডানা মেলে খুবই কম বসে। এরা রোদ পোহানো শেষে আবছা আলোয় শুকনো পাতার ওপর অবস্থান করতে বেশি পছন্দ করে। এরা সাধারণত সকালে, পড়ন্ত বিকেল ও সন্ধ্যায় পুরোপুরি সক্রিয় হয়।
জংলাবিড়া প্রজাপতিরা পশু-পাখির বিষ্ঠা, পচা ফল, ভিজেমাটি বা পাথরের ভিজে ছোপে বসে খাদ্যরস আহরণ করে। তবে ভিজেমাটি ও স্যাঁতসেঁতে দেয়াল বা পাথরে বসে খাদ্যরস আহরণ করতে পুরুষদেরই দেখা যায়। এদের ডিম গোলাকার ও ময়লাটে সাদা বর্ণের হয়ে থাকে। এদের শূককীটের বর্ণ খয়েরি। শূককীটের আহার্য বিভিন্ন প্রকার ঘাস। ঘাসের ফলকের নিচের তলে শূককীট লম্বালম্বিভাবে অবস্থান করে ও ফলকের পাশ থেকে খাওয়া শুরু করে।
তবে সম্পূর্ণ ঘাসটিকে মুড়িয়ে খেয়ে শেষ করার লক্ষণ দেখা যায় না। একটুখানি খেয়েই অন্যকোনো ঘাসে চলে যায়। এদের মুককীট সৃষ্টি হয় ঘাসের নিম্নপৃষ্ঠে। মুককীটের রং সবুজ, দেহের নানা স্থানে হলুদ বিন্দুযুক্ত। বক্ষদেশ ও উদর দুইই পিঠের দিকে অনেকটা ফোলানো। তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে পূর্ণ প্রজাপতি হয়ে ওঠে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মাসুদ রানা কালবেলাকে বলেন, জংলাবিড়া প্রজাপতি দেখতে খুব সুন্দর। ডানা বন্ধ অবস্থায় দেখতে বেশ ভালো লাগে। এদের বন্ধ ডানা দেখলে মনে হবে যেন কোনো শিল্পী তার তুলির আঁচড় দিয়ে আলপনা এঁকেছেন। এরা পরিবেশ ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে এদের বাচ্চা (লার্ভা) ফসলের কচি পাতা খেয়ে থাকে।
মন্তব্য করুন