

প্রকৃতির নিজস্ব নিয়ম থাকলেও মাঝে মধ্যে সে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে। ঋতুর ছন্দপতনে প্রকৃতি নিজেই ভেঙে দেয় সেই নিয়ম। তেমনি প্রকৃতির নিয়ম ভেঙে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ায় বৈশাখের বরুণ ফুল ফুটেছে অগ্রহায়ণে।
সাধারণত গ্রীষ্ম মৌসুমে যার স্বাভাবিক প্রস্ফুটন, সেই বরুণ এবার ফুটেছে হেমন্তে, পুরোপুরি অসময়ে। আর এ অপ্রত্যাশিত ফোটা ফুলের রং, গন্ধ ও সৌন্দর্যে পথচারী, প্রকৃতিপ্রেমী ও স্থানীয়রা সমানভাবে বিস্মিত ও অভিভূত হচ্ছেন।
অসময়ে ফোটা বরুণ ফুলের মোহনীয় সৌন্দর্যের এমন মোহনীয় দৃশ্য দেখা গেছে উপজেলার গোপালনগর এলাকার একটি খালপাড়ের গাছে। বরুণ ফুলের নৈসর্গিক সৌন্দর্যে খালপাড়ের প্রকৃতিও যেন অলংকৃত হয়ে উঠেছে অপরূপ সৌন্দর্যে।
স্থানীয়রা জানান, কয়েকদিন আগে হঠাৎ করেই গাছভর্তি সাদা-হালকা গোলাপি রঙের বরুণ ফুল তাদের চোখে পড়ে। ক্রমান্বয়ে গাছভর্তি নতুন কুঁড়ি ও সতেজ ফুলে ঝলমল করতে শুরু করেছে বরুণ ফুল।
এদিকে এমন অসময়ে বরুণ ফুলের প্রস্ফুটন প্রকৃতিপ্রেমীদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দা ও প্রকৃতিপ্রেমীরা মনে করছেন, প্রকৃতির নিয়মের গণ্ডি পেরিয়ে অসময়ে বরুণ ফুল ফোটার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারণই সবচেয়ে বেশি দায়ী। এর ফলে ঋতুর স্বাভাবিক ছন্দে পতন ঘটছে। যার ফলে নির্দিষ্ট নিয়মের বাইরেও প্রকৃতিতে ঘটছে নানা ঘটনা। তবে অসময়ে বিভিন্ন উদ্ভিদে ফুল ও ফল ধরার পেছনে শুধু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাই নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ নিয়ে রয়েছে কৌতূহল ও বিস্ময়ের অনুভূতি।
সরেজমিন দেখা গেছে, অসময়ে ফোটা বরুণ ফুলের চোখজুড়ানো সৌন্দর্য প্রকৃতি ও ফুলপ্রেমীদের দৃষ্টি কাড়ার পাশাপাশি আশ্চর্য করেছে। তবু অসময়ে ফোটা এ ফুলের অনন্য রূপ ও সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হচ্ছেন সমবয়সি মানুষ। ফুলের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে অনেকে মোবাইল ক্যামেরায় ধরে রাখছেন ফুলের নৈসর্গিক সৌন্দর্য। কেউ আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে অসময়ে ফোটা বরুণ ফুলের মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছেন নেট-দুনিয়ায়।
জানা গেছে, বরুণ গাছের বৈজ্ঞানিক নাম ক্রেতেভা রিলিজিওসা। এটি ক্রেতেভা গণের একটি ঔষধি বা ফুল গাছ। এটি জাপান, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং কতিপয় দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের স্থানীয় গাছ। এ গাছে সাধারণত বসন্তের নতুন পাতার পরে গ্রীষ্মের শুরুতে বড় থোকায় থোকায় সাদা এবং বেগুনি রঙের ফুল ফোটে। বোঁটা ৩ থেকে ৫ সেন্টিমিটার লম্বা হয়ে থাকে। এর ৫টি মুক্ত পাপড়ি থাকে। সাধারণত খাল, নদী বা জলাশয়ের আশপাশে এ গাছ বেশি জন্মে।
এ গাছ ১০ থেকে ১৫ মিটার উঁচু হয়ে থাকে। এ গাছের পাতার উপরিভাগ চকচকে। নিচের অংশ ফ্যাকাশে। বরুণ ফুলের একাধিক নাম রয়েছে যেমন, বর্না, বালাই, বিদাসি, অবিয়ুচ ইত্যাদি। এ গাছের ফল গোলাকার বা ডিম্বাকার। এর ফল শাঁসালো ও শক্ত হয়ে থাকে। বরুণ ভেষজ গুণসম্পন্ন গাছ। এর পাতা, ফুল, ফল, শিকড় ও বাকল নানা রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে ব্যবহার করা হয়।
সাহেবাবাদ ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী ফয়সল জোনায়েদ রাব্বি বলেন, খালপাড়ে ফোটা বরুণ ফুল আমাদের মুগ্ধ করছে। যদিও গাছে কম ফুল ফুটেছে, তবু ফুলগুলো আমাদের আকৃষ্ট করছে। অসময়ে ফোটার কারণে বেশি ভালো লাগছে।
স্থানীয় বাসিন্দা হারুনর রশীদ বলেন, আমাদের খালপাড়ের একটি ছোট বরুণ গাছে সীমিত পরিসরে ফুল ফুটেছে। সুন্দর দেখাচ্ছে ফুলগুলো। যদিও এই সময়ে বরুণ ফুল ফোটার কথা নয়, তবু এই ফুল ফোটায় আশ্চর্য হওয়ার পাশাপাশি অভিভূত হয়েছি। এ বরুণ গাছ ছাড়াও আমাদের বাড়ির আশপাশে আরও কয়েকটি বরুণ গাছ রয়েছে। তবে সেগুলোতে কোনো ফুল ফোটেনি।
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মাসুদ রানা কালবেলাকে বলেন, প্রকৃতির এ অপ্রত্যাশিত রূপ একদিকে যেমন মুগ্ধতা বিলাচ্ছে, অন্যদিকে পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের দিচ্ছে নতুন ভাবনার খোরাক। এ চিত্র প্রশ্ন তুলছে, জলবায়ুর পরিবর্তন আমাদের ভবিষ্যৎকে কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে। অসময়ে ফোটা বরুণ ফুল তাই আজ শুধু একটি ফুল নয়, প্রকৃতির এক নীরব বার্তা।
তিনি আরও বলেন, আবহাওয়ার অনিয়ম, তাপমাত্রার হঠাৎ ওঠানামা কিংবা পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে অনেক গাছই এখন মৌসুমের বাইরে ফুল-ফল দিচ্ছে। বরুণ ফুলের এ অসময়ে ফোটা সেই পরিবর্তনেরই প্রমাণ। পরিবেশের ওপর মানুষের প্রভাব ও জলবায়ুর অস্বাভাবিকতা ক্রমে প্রকৃতির স্বাভাবিক চক্রে পরিবর্তন আনছে।
মাসুদ রানা বলেন, এজন্য আমাদের সকলকে আরও বেশি সচেতন হয়ে জলবায়ুর স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হবে। তবেই ষড়ঋতুর বাংলাদেশে ঋতুর ছন্দ যথাযথ ফিরে আসবে। পরিবেশ তার স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে পাবে।
মন্তব্য করুন