

ব্রিটিশ শাসনবিরোধী আন্দোলনে প্রথম বাঙালি শহীদ (আত্মবলিদানকারী) প্রফুল্ল চাকীর শেষ স্মৃতি চিহ্নটুকু মুছে যাচ্ছে। অযত্নে অবহেলায় পড়ে থেকে তা দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে। এই বীর শহীদের স্মৃতি রক্ষার্থে সরকারি বা বেসরকারিভাবে তার নিজ গ্রামে তেমন কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই।
এলাকাবাসী দীর্ঘদিন ধরে প্রফুল্ল চাকীর নামে একটা কিছু করার দাবি জানিয়ে আসলেও কারও কোনো উদ্যোগ নেই। উল্টো অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে থেকে তার শেষ চিহ্ন উপজেলার বিহার পোদ্দার পাড়ার ৬ শতক বাস্তু ভিটাটুকুও বেদখল হওয়ার পথে।
আশপাশের বাসিন্দারা ওই জায়গাটুকু ধীরে ধীরে ব্যবহারের নামে দখল করে নিচ্ছে। বর্তমানে সেখানে বেসরকারি উদ্যোগে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও সেটি এখন জীর্ণদশায়।
গত ১০ ডিসেম্বর ছিল ব্রিটিশ শাসনবিরোধী আন্দোলনে প্রথম বাঙালি শহীদ (আত্মদানকারী) প্রফুল্ল চাকীর ১৩৭তম জন্ম বার্ষিকী। ১৮৮৮ সালের এই দিনে তিনি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বিহার গ্রামের সম্ভ্রান্ত চাকী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
এলাকাবাসী জানান, এ গ্রামের মাটি ধন্য এক সংগ্রামীর গৌরব গাঁথায়। প্রফুল্ল চাকীর স্মরণে তার বাস্তুভিটা সংরক্ষণ করে সেখানে এমন কিছু করা হোক যেখান থেকে প্রফুল্ল চাকী সম্পর্কে আগামী প্রজন্ম তার সম্পর্কে, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে কিছু জানতে পারবে।
বিহার গ্রামের বাসিন্দা নামুজা ডিগ্রি কলেজের সিনিয়র প্রভাষক রফিকুল ইমলাম ভাণ্ডারি বলেন, তার স্মৃতি রক্ষায় একটি হাসপাতাল বা বিদ্যালয় অথবা একটি পাঠাগার নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের। ইতোপূর্বে বিহারহাটে অবস্থিত ইউপি ভবনটি স্মৃতি পাঠাগার হিসেবে দানপত্র করে দেওয়া হলেও সেখানে কোনো পাঠাগার স্থাপন করা হয়নি।
এলাকাবাসী জানায়, প্রফুল চাকীর বাবা রাজ নারায়ণ চাকী ও মা স্বর্ণময়ী দেবীর ছয় ছেলেমেয়ের মাঝে তিনি ছিলেন চতুর্থ সন্তান। বাবা ছিলেন বগুড়ার নবাব পরিবারের কর্মচারী।
তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার আন্দোলন দমনের জন্য নির্যাতনের পথ ধরে। আর রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের প্রধান ব্যক্তি ছিলেন কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংস ফোর্ড। এই ফোর্ডকে হত্যা করতে প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসু ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল রাতে দিকে তার ঘোড়ার গাড়িকে লক্ষ্য করে বোমা ছুড়ে মারেন।
কিন্তু গাড়িতে এ সময় ফোর্ড ছিলেন না। ছিলেন ইংরেজ ব্যারিস্টার কেনেডির স্ত্রী-কন্যা; তারা মারা যান। পরে দুজন পালাতে গিয়ে ক্ষুদিরাম বসু ১ মে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। পরদিন অর্থাৎ ২ মে পালানোর সময় ট্রেনে প্রফুল্ল চাকী পুলিশের নজরে পড়েন।
এ সময় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করলে তিনি গ্রেপ্তার নিশ্চিত জেনে মোজাফফরপুর স্টেশনে তার নিজের পিস্তল দিয়ে মাথায় গুলি করে আত্মবলিদান করেন। একই বছরের ১১ মে ক্ষুদিরামকে ফাঁসি দেওয়া হয়। জীবন দিয়ে তারা প্রমাণ করেন— বিপ্লবীরা মরে তবু মাথা নোয়ায় না।
শিবগঞ্জের শহীদ প্রফুল্ল চাকী স্মৃতি সংসদ ও পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিউল আযম সজল জানান, প্রফুল্ল চাকীর বাস্তুভিটায় সরকারিভাবে সাহায্য নিয়ে কিছু একটা করার জন্য কয়েকবার বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে ধরনা দিয়েও কোনো সাঁড়া পাওয়া যায়নি। তবে স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে ইতোপূর্বে চেষ্টা চালানোর ফলে ছবিসহ তার সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। এখন কেউ আর এ দিবসটি পালন করেন না। নীরবে এসে নীরবেই দিনটি চলে যায়।
শিবগঞ্জ উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুবীর কুমার দত্ত কালবেলাকে বলেন, প্রফুল্ল চাকীর বাস্তুভিটা রক্ষায় সরকারিভাবে সাহায্য প্রয়োজন।
শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান কালবেলাকে বলেন, শহীদ প্রফুল্ল চাকী শিবগঞ্জ তথা বাংলাদেশের গর্বিত সন্তান। ইতোমধ্যেই তার বাস্তুভিটার অর্ধেক করতোয়া নদীর ভাঙনে বিলীন হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি নদীর তীর সংরক্ষণ করে তার স্মৃতি রক্ষার্থে সেখানে পাঠাগার বা অন্য কিছু করার। তার স্মরণে কিছু একটা করার জন্য উপজেলা পরিষদ থেকে জোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
মন্তব্য করুন