কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ায় উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে আইন পাস করে নিষিদ্ধ করা স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার। প্রকাশ্যে এখন এর ব্যবহার চলছে যত্রতত্র। হাটবাজারগুলোতে হাতলওয়ালা ও হাতল ছাড়া সাদা পলিথিন ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন ওই এলাকার সচেতন মহল। শুধু আইন নয়, পলিথিন বন্ধে আইনের প্রয়োগও বাড়াতে হবে বলে মনে করছেন সচেতনরা। আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবেই নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার বাড়ছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, হাটবাজার, কাঁচাবাজার, দোকান, ফার্মেসি ও রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে পণ্য বহনে ব্যবহৃত হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ। একবার ব্যবহারের পর পলিথিন ব্যবহার শেষে সেগুলো ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে যত্রতত্র। যা পরিবেশকে ঠেলে দিচ্ছে হুমকির মুখে। পলিথিনের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার, উৎপাদন, বিপণন নিষিদ্ধ হলেও এর ব্যবহার রোধে কর্তৃপক্ষের নজর নেই বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
জানা গেছে, বাংলাদেশে ১৯৮২ সালে সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভাবে পলিথিন ব্যাগ তৈরি ও ব্যবহার শুরু হয়। আর এটি ব্যবহারে সুবিধা ও সহজলভ্য হওয়ায় অতি অল্প সময়ের মধ্যেই দেশে পলিথিন ব্যাগের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। পরে গবেষণার মাধ্যমে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর এর বিরূপ প্রভাবের চিত্র উঠে এলে পলিথিন উৎপাদন, বিক্রয় ও ব্যবহার বন্ধে আইন প্রনয়ণ করে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়।
গবেষণা বলছে, পলিথিন ভীষণ বিষাক্ত প্রোপাইলিনের সঙ্গে পেট্রোলিয়াম হাইড্রোকার্বনের ৩ থেকে ৪টি মলিকুলের সাবমিশ্রণে তৈরি। পলিথিন বহুমাত্রিক ক্ষতির বাহক। পলিথিন ও প্লাস্টিক দ্রব্য পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। প্লাস্টিক এমন একটি পদার্থ যার আয়ুষ্কাল হাজার হাজার বছর, যা মাটিতে গেলে ক্ষয় হয় না বা মাটির সঙ্গে মিশে যায় না। এটি মাটিতে পানি ও প্রাকৃতিক যে পুষ্টি উপাদান রয়েছ তার চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে মাটির গুণগত মান হ্রাস পায়। গাছ তার খাবার পায় না। মাটি ও পানিতে প্লাস্টিক কণা ছড়িয়ে পড়ে, যা হয়ত পানি থেকে মাছের শরীরে যাচ্ছে। তারপর যাচ্ছে মানুষের শরীরে। এতে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য দিনদিন হুমকির মধ্যে পতিত হচ্ছে।
তাই পরিবেশের ওপর পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাবের কথা চিন্তা করে জানুয়ারি ২০০২ সালে আইন প্রণয়ন করে প্রথমে ঢাকা শহরে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। পরে ২ মার্চ ২০০২ সালে সারা দেশে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়।
কুমিল্লা জজ কোর্টের বিজ্ঞ আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুল আলীম খান বলেন, প্রতিবছরই পত্রপত্রিকায় দেখি পাট চাষিদের হতাশার চিত্র। পরিবেশ দূষণ রোধে ও জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে সবাই সম্মিলিতভাবে পলিথিন বর্জন করে পাটের ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে। এতে ব্যয় কিছুটা বাড়লেও দেশ ও জাতির উপকার হবে। পাট শিল্পেও আশার প্রতিফলন ঘটবে এবং বাড়বে পাটচাষি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মাহবুবুল হাসান বলেন, পলিথিন অপচনশীল পদার্থ হওয়ায় দীর্ঘদিন প্রকৃতিতে অবিকৃত অবস্থায় থেকে মাটিতে সূর্যালোক, পানি ও অন্যান্য উপাদান প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে। পচে না বলে মাটির উর্বরতা শক্তি কমে যায় ও উপকারী ব্যাকটেরিয়া বিস্তারে বাধা তৈরি করে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবু হাসনাত মো. মহিউদ্দিন মুবিন বলেন, পলিথিন শুধু পরিবেশের ক্ষতি নয়, পলিথিন মোড়ানো গরম খাবার খেলে মানুষের ক্যান্সার ও চর্মরোগের সংক্রমণ হতে পারে। পলিথিনে মাছ ও মাংস প্যাকিং করলে তাতে অবায়বীয় ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্টি হয়, যা দ্রুত পচনে সহায়তা করে। অন্যদিকে উজ্জ্বল রঙের পলিথিনে রয়েছে সীসা ও ক্যাডমিয়াম যার সংস্পর্শে শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত ও চর্মপ্রদাহের সৃষ্টি হয়।
তিনি আরও বলেন, পলিথিন ব্যাগের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে দেশে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে। ক্যান্সার, কিডনি, চর্মরোগ এবং বন্ধ্যাত্বসহ নানা রোগের অন্যতম কারণ পলিথিনে থাকা কেমিকেল। এটির লাগাম এখনই টেনে না ধরলে ভবিষ্যতে এমন নানান রোগের মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ( ইউএনও ) স ম আজহারুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনের নজরে এসেছে। আমরা খুব শিগগিরই এ ব্যপারে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করব।
কুমিল্লা পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক নুরুদ্দিন বলেন, পলিথিন পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আমরা নিয়মিত মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে পলিথিন ব্যবসায়ী, বহনকারী এবং উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সময়ে আর্থিক জরিমানা করে আসছি। সম্প্রতি কুমিল্লা বিসিকে একটি পলিথিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সিলগালা করেছি। আমাদের এ অভিযান অব্যাহত থাকবে ।
মন্তব্য করুন