চলনবিল অধ্যুষিত আদিবাসী পল্লীতে ঢোল মাদলের সুর মূর্ছনায় ও গরুর নাচের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী সহরায় পরব উৎসব।
মঙ্গলবার (১৪ নভেম্বর) দিনব্যাপী সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার পশ্চিম আটঘরিয়া গ্রামে এ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। সব বয়সী আদিবাসী শিশু, নারী-পুরুষের পরবে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন। সব জায়গায়ই ছিল উৎসব আমেজ।
জানা গেছে, চলনবিল অধূষ্যিত পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও নাটোর জেলার সিংড়া, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া, তাড়াশ, রায়গঞ্জ, সরাপপুর, গোথিতা, বাঘল বাড়ি, কাটাগাড়ি, পশ্চিম আটঘরিয়া, গুল্টা, গুড়পিপুল, নিমগাছী, সরাতলা, মাধাইনগর, দত্তবাড়ি, কালীবাড়ি, খৈচালা, বস্তুল, মানিকচাপর, ক্ষীরশিনসহ অন্তত অর্ধ শতাধিক গ্রামের আদিবাসীরা বংশ পরম্পরায় এ পরব পালন করছেন।
তবে মাহাতো সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের ধর্মীয় উৎসব সহরায় পরবের বেশি আয়োজন করে থাকেন। আর চলনবিলে আদিবাসী পল্লীতে এ বছরও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ছিল না আয়োজনের ঘাটতি।
সরজমিনে গত মঙ্গলবার বিকেলে রায়গঞ্জ উপজেলার পশ্চিম আটঘরিয়া গ্রামের উজ্জল মাহাতোর বাড়ির আঙিনায় গিয়ে দেখা যায়, চাউলের গুড়া পিপলটি গাছের পাতার রস কিঞ্চিত পানিতে মিশিয়ে তৈরি সাদা রঙের তরল দিয়ে অল্পনা আঁকা হয়। তারপর বাড়ির গবাদি প্রাণী গরুর শিং এ সিঁদুর, তেল, ধানের শিষ বেঁধে ধূপের ধোঁয়ায় সম্মান জানানো হয়। তাকে আদিবাসি মাহাতো সম্প্রদায়ের লোকেরা চুমান বলে। আর তখন পাড়ার বর্হি বাটিতে ঝুমুর বা জাগরনা নাচের মোহনীয় নৃত্যে মেতে ওঠা শিশু-কিশোর, কিশোরীসহ আদিবাসী পল্লীর সব শ্রেনীর নারী-পুরুষে গম গম করছিলো স্থানটি। আবার সেখানে পোঁতা ছিল শক্ত বাঁশ। তাতে নতুন রশি। আলতা সিঁদুরে রাঙানো রশিতে টাগরা একটি লাল রঙের বাছুরকে বেঁধে রাখা হয় একে আদিবাসি কুড়মাালি ভাষায় বলে বারাদ খুঁটা।
আর বারাদ খুঁটার গরুটিকে ঢাক, ঢোল, মাদল বাঁজিয়ে জাগরনা গানের সঙ্গে সঙ্গে খুঁটাতে থাকেন অনেকে মিলে। যাতে গরুটি উত্তাক্ত হয়ে লাফলাফি করে। এটাও তাদের ধর্মীয় উৎসবের অংশ।
পশ্চিম আটঘরিয়া গ্রামের বাসিন্দা চঞ্চল মাহাতো জানান, কার্তিকের অমাবশ্যায় সহরাই পরব বা উৎসবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কৃষিজীবি পরিবারগুলোতে চাষাবাদে ব্যবহৃত গবাদি পশু গরুর প্রতি চুমান বা সম্মান করে যত্নবান হয়ে থাকেন। কেননা হেমন্তকালে জমির কঠিন মাটিকে চাষ যোগ্য করার জন্য ধর্মীয় রীতি মেনে তারা গবাদি পশুর যত্ন নিয়ে থাকেন এবং গোয়াল পূজায় মনোনিবেশ করেন। যাতে করে ধন ধান্যে ভরে উঠে প্রতিটি কৃষকের গোলা।
রায়গঞ্জ উপজেলা আদিবাসী বহুমূখী উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি অখিল মাহতো বলেন, চলনবিলের আদিবাসী পল্লীতে বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্র্যময় নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে এ বছরও কার্তিকের অমাবস্যায় শুরু হওয়া আদিবাসী সম্প্রদায়ের তিন দিনব্যাপী তাদের অন্যতম ধর্মীয় পরব সহরাই বা গোয়াল পূজা উদযাপিত হয়।
আর তা গত মঙ্গলবার ঢোল মাদলের সূর মূচ্ছনায় গরুর নাচের সঙ্গে মধ্যরাত পর্যন্ত মহনীয় ঝুমুর নাচ দিয়ে শেষ হয় আদিবাসীদের তিন দিনের অন্যতম বড় ধর্মীয় পরব সহরাই।
মূলত গোয়াল দেবতা আদিবাসীদের কাছে বংশ পরম্পরায় সুখ, সমৃদ্ধি ও শক্তির দেবতা হিসেবে পূজিত হয়ে আসছেন। আর তাকে সন্তেষ্ট করতেই এ আয়োজন।
এ প্রসঙ্গে আদিবাসী মাহাতো সম্প্রদায়ের কুড়মালী ভাষার লেখক ও আদিবাসী গবেষক উজ্জল মাহাতো বলেন, ‘তিন দিনের সহরায় পরবে চলনবিলের আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে প্রতিটি বাড়িতে দিয়ালি জ্বালান, গোয়াল ঘরসহ সকল ঘরবাড়ি পরিষ্কার করার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় উৎসব আয়োজন চলছিল। সেই সঙ্গে পরবের ধারাবাহিকতায় গবাদি পশুদের গোসল করানো, শিংয়ে তেল, সিঁদুরে রাঙানো তো ছিলই। সেই সঙ্গে আরেকবার পাঁঠা, লাল মোরগ-মুরগি, ভেড়ার পাঁঠা, হলুদ সুতা, কাঁঠাল ও বেলপাতা, ধুপ, সিঁদূর, আতপ চাল, দুর্বা ঘাস দিয়ে পূঁজার পর সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভের জন্য প্রার্থনা সম্পন্ন করবেন ধর্মপ্রাণ আদিবাসীরা।
পাশাপাশি এ দিনই সহরাই পরবে আতপ চালের সঙ্গে পাঁঠার মাথার মাংস দিয়ে রান্না করা হবে খিচুরি এবং আলাদাভাবে পাঁঠা বা মূরগীর মাংস দিয়ে রান্না করা মাংসের তরকারি। আর নানা ধরনের পিঠায় দিয়ে চলে পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী ও আগত অতিথিদের আপ্যায়ন। আর কোনো গৃহে এ অপ্যায়নের কমতি থাকে না।
মন্তব্য করুন