ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার চরাঞ্চলে লাফা ও তাল বেগুনের আবাদ বেড়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল এলাকায় প্রান্তিক চাষিরা লাফা এবং তাল বেগুন আবাদ করে এখন লাভবান হচ্ছেন।
গফরগাঁওয়ের বেগুনের স্বাদ ও গন্ধে অতুলনীয়। এ বেগুনের আকৃতি গোল কিন্তু দেহ মসৃণ নয়। তাল বেগুনও দেখতে ঠিক লাফা বেগুনের মতো। কিন্তু এ বেগুন ঢেউ খেলানো খাঁজ কাটা নয়। সারা দেশের ঐতিহ্যবাহী গফরগাঁওয়ের বেগুন। অনেকেই একে গোল বেগুন বলে ডাকে। বড়া ও ভাজির জন্য প্রসিদ্ধ ও সুস্বাদু এ তাল বেগুন। এক সময়ে বিয়ের উৎসবে ঐতিহ্যবাহী লাফা গফরগাঁওয়ের বেগুন খাদ্যের তালিকায় না থাকলে বরপক্ষের খাবারে অপূর্ণতা থেকে যেত। এমন ঘটনা ঘটেছে বরকে বড় থালায় খাবার দেওয়া হলে সেই থালা লাফা বেগুনের ভাজা না থাকলে বর বিয়েতে অস্বীকৃতি জানাতো।
গফরগাঁওয়ের লাফা বেগুন নিয়ে চাকরি প্রার্থীরা বড় কর্মকর্তার দরজায় হাজির হলে তাদের ভাগ্যে মিলে যেত চাকরি। নানা সমস্যার কারণে বিলুপ্তি হয়ে যাওয়া বেগুন চরাঞ্চলে কৃষকরা আবার আবাদ শুরু করেছেন। গফরগাঁওয়ের চরআলগী নয়াপাড়া গ্রামের কৃষক গোলাম বর এবং ছামিদ মিয়া লাফা বেগুন চাষ করেছেন।
এক সময়ে গফরগাঁও উপজেলার চরআলগী ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকায় লাফা বেগুনের চাষ হতো। একটি বেগুনের ওজন হতো ২ থেকে ৩ কেজি পর্যন্ত কোনো প্রকার সার প্রয়োগ ছাড়াই এ বেগুন উৎপাদন হতো।
লাফা বেগুনের ক্ষেতে কোনো রকম অপবিত্র শরীর নিয়ে গেলে কয়েক দিন পরেই বেগুনের গাছ মরে যায়। ব্রক্ষ্মপুত্র নদের ভাঙনে লাফা বেগুন চাষাবাদের জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। লাফা বেগুনের উন্নত বীজ কোথাও না পেয়ে কৃষকরা নিরূপায় হয়ে লাফা বেগুনের পরিবর্তে বিভিন্ন জাতের বেগুন চাষ করছে। এদের মধ্যে হলো : গোল আকৃতির লাফা বেগুন, তাল বেগুন, ভোলানাথ, সিংনাথ, ইসলামপুরী, বারী বেগুন, খটখটিয়া, তারা ও ঝুড়ি বেগুনের চাষ।
চরআলগীর কৃষক হামিদ মিয়া জানান, বিলুপ্ত হওয়া লাফা বেগুনের বীজ অনেক কষ্ট করে ইসলামপুর থেকে সংগ্রহ কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে এক একর ৫০ শতাংশ জমিত লাফা বেগুন চাষ করেছি। বেগুন চাষ করতে প্রায় ৯০ থেকে ১ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এ পর্যন্ত বিক্রি করেছি প্রায় অর্ধ লক্ষ টাকার মতো। চলতি মৌসমে বাজারে ৪ হাজার ৮০৫ হাজার পর্যন্ত ১ মণ বেগুন বিক্রি করছি। দর ভালো থাকায় আশা করছি এ বছর প্রায় ৪ থেকে সাড়ে ৫ লাখ টাকার উপরে বেগুন বিক্রি করতে পারব বলে কৃষক হামিদ ও গোলাম রব জানিয়েছেন।
কৃষক রিপন, গোলাম রব বলেন, লাফা বেগুন চাষের জন্য উন্নত বীজ না থাকায় এর বিকল্প হিসেবে আমরা ভোলানাথ ও ইসলামপুরী বেগুনের চাষাবাদ করছি। ইসলামপুরী ও ভোলানাথ বেগুন দেখতে অনেকটা লাফা বেগুনের মতো দামও ভালো। তবে খাওয়ায় স্বাদ কম। এবার চরআলগী ইউনিয়নের গোলাম রব ও হামিদ ২৪ বছর পর লাফা বেগুনের চাষ করে গফরগাঁও তথা ময়মনসিংহের ঐতিহ্য রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
লাফা বেগুন এর অপর চাষি জীবন মিয়া জানান, বংশানুক্রমিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে দু-একজন চাষি লাফা বেগুনের চাষ করেন। আগের মতো আর এখন লাফা বেগুনের চাষ হয় না। ভরা শীত মৌসুমে চলে লাফা বেগুনের চাষ। রাতের শেষ প্রহরে মাটির অলট-পালট করে দিতে হয়। প্রতি সপ্তাহে অল্প সেচ দিতে হয়। জাতের বেগুন গাছ মাটি থেকে প্রচুর পরিমাণ রস টেনে নেয়। কৃষক জীবন মিয়ার দাবি জরুরি ভিত্তিতে লাফা বেগুনের ভালো বীজ সংরক্ষণের জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রকিব আল রানা জানান চলতি মৌসুমে ৮০০ একর জমিতে বিভিন্ন জাতের বেগুনের চাষ হচ্ছে। চরআলগী, টাঙ্গাব, দত্তের বাজার ও সালটিয়া ইউনিয়নে বেগুনের চাষ হয়ে থাকে। এই ৫টি ইউনিয়নের প্রায় ১৬শ পরিবার বেগুন চাষে সুফল ভোগ করবে। গফরগাঁওয়ের চরআলগী ইউনিয়নের কৃষকরা লাফা এবং বেগুন আবাদ করে বাংলাদেশে মধ্যে আবার গফরগাঁওয়ের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে বলে তিনি আরও জানান।
মন্তব্য করুন