নজরুল ইসলাম (৮২)। ছিলেন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পিঅ্যান্ডডি দপ্তরের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী (এইএন)। ২০০১ সালের ২৯ এপ্রিল এই পদ থেকে চূড়ান্ত অবসরে যান তিনি। কিন্তু দীর্ঘ ২২ বছর ধরে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরেও তার গ্র্যাচুইটির ৫ লাখ ৩২ হাজার ৩২৮ টাকা পাননি। শুধু তাই নয়, গ্র্যাচুইটির এই টাকা পেতে প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতিকেও দিয়েছিলেন চিঠি। সর্বশেষ চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি এই টাকা ফেরত পেতে পরিবহন অডিট অধিদপ্তরের মহাপরিচালককেও দিয়েছিলেন পত্র। কিন্তু কোনটিতেই কাজ হয়নি। দীর্ঘ ২২ বছরেও গ্র্যাচুইটির টাকা না পেয়ে তিনবার ব্রেইট স্ট্রক করেছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে গ্র্যাচুইটির এই টাকা পেয়েই পরপারে চলে যেতে চান ৮২ বছর বয়সী নজরুল। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও কামনা করেন তিনি।
ভুক্তভোগী নজরুল অভিযোগ করে বলেন, ২০০১ সালের ২৯ এপ্রিল অবসরে যাওয়ার যাওয়ার কয়েক মাস পর আমি গ্র্যাচুইটির জন্য পেনশন শাখায় আবেদন করি। ওই অফিসের তৎকালীন প্রধান সহকারী (বড় বাবু) দলিল উদ্দিন বলেন, এভাবে ঘুরলে হবে না। কিছু পয়সাকড়ি দিতে হবে। আমার একটা বন্ধু ছিল পানি উন্নয়ন বোর্ডের ইঞ্জিনিয়ার। তাকে অনুরোধ করে বললাম, টাকার কথা। সে আমাকে তিন হাজার টাকা দেন। তিন হাজার টাকা নিয়ে আমি তাকে বললাম- আমি লোন হিসেবে নিচ্ছি, টাকা পেলে আপনাকে ফেরত দিয়ে দেব। তিন হাজার টাকা আমি ওই বড় বাবুর হাতে দিলাম। এভাবে আরও বেশ কিছুদিন কেটে গেল। পরে হঠাৎ একদিন বলে, এতে তো হবে না। আরও কিছু টাকা দেন। আমার কিছু কলিগ ছিল। তাদের ধরে বললাম যে, তিন হাজার টাকা দিয়েছি। তারপরেও চাচ্ছে। তখন ওদের কাছে থেকে হাজার পাঁচ-সাতেক টাকা নিয়ে দিয়েছি। এরপরে আমি প্রায় চার মাস ঘুরেছি। তখন সে আমাকে বলেছে, আমাকে বলে যে, চিফ ইঞ্জিনিয়ার (তৎকালীন) বলেছে ৫০ হাজার টাকা লাগবে। আমি বলেছি, দিতে পারব না। তারপরে আমি বহু ঘুরাঘুরি ও দৌড়াদৌড়ি করেছি। কিন্তু আজও আমার গ্র্যাচুইটির টাকা পাইনি।
নজরুল ইসলাম বলেন, আমি অনেক অনুনয়-বিনয় করেছি। চাকরি জীবনে যেসব জায়গায় কাজ করেছি তার সব কাগজ দেখিয়েছি। আমি ১৫ থেকে ১৬ জায়গায় কাজের সব প্রশংসাপত্র দিয়েছি। আমার সবই পরিষ্কার, ঠিক আছে। আমি শুধু ঘুরছি আর ঘুরছি। টাকা পাইনি। আমি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছি। প্রধান বিচারপতিকে (বর্তমান ও সাবেক) চিঠি দিয়েছি। আমার কাগজপত্রে আমার চিফ ইঞ্জিনিয়ার (সাবেক) লিখেছেন, আপনার একটা অডিট অপত্তি ছিল। যেটা বাদ দিয়ে আপনার টাকা দেওয়ার কথা বলেছে ঢাকার সিজিও অফিসকে। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘আমার বড় ছেলে পাঁচ বছর আগে স্ট্রোক করে মারা গেছে। সে আমার সব খরচ দিত। তার স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে। এক সন্তান অষ্টম শ্রেণি আরেক সন্তান দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। আমার ছেলের বউ ও দুই নাতি-নাতনিকে এখন আমাকে ভরণ-পোষণ দিতে হয়।’ তিনি বলেন, আমার এখন দুই ছেলে আছে। তারা অল্প বেতনে চাকরি করে। তাদের নিজের সংসার চালাতেই তারা হিমশিম খায়। আমি বাড়ি ভাড়া বাবদ সাত হাজার টাকা পাই। তা দিয়েই কোনোমতে কষ্টে দিনাতিপাত করছি।
নজরুল আরও বলেন, ‘আমার এই গ্র্যাচুইটির টাকা চেয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজারসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেছি। কয়েকদিন আগেও জেনারেল ম্যানেজারের নিকট গিয়ে অনেক অনুনয়-বিনয় করে আসছি। তিনি বলেছেন আপনি এই টাকা পাবেন না। অথচ গত বছরের ৩ জুলাই আামার গ্র্যাচুইটির টাকা ফেরত প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলীর পক্ষে নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন (পিএন্ডডি) পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান হিসাব অধিকর্তাকে (এফএএন্ডসিএও) চিঠির মাধ্যমে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই টাকা অদ্যাবধি পাইনি।’
নজরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমি এই টাকার জন্য তিনবার স্ট্রোক করেছি। একবার জিএম কার্যালয়ে আর দুবার বাড়িতে। আমি এই শেষ সময়ে প্রধানমন্ত্রীর নিকট অনুরোধ জানাচ্ছি যাতে তিনি আমার এই টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
তিনি বলেন, ১৯৭১-৭২ অর্থবছর হতে ২০০৯-১০ অর্থবছর পর্যন্ত সকল সাধারণ আপত্তি নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মাধ্যমে আমি আমার গ্র্যাচুইটির টাকা ফেরত চেয়েছি। এটি আমার অধিকার। কিন্তু আমাকে সেই টাকা দেওয়া হচ্ছে না।
জানতে চাইলে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী (পিঅ্যান্ডডি) মো. আনোয়ার হোসেন জানান, আমরা তার গ্র্যাচুইটির টাকা ফেরত দিতে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের এফএএন্ডসিএওকে চিঠি দিয়েছি। সেই দায়িত্ব এখন ওই দপ্তরের।’
এ বিষয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) অসীম কুমার তালুকদার বলেন, ১৯৭১-৭২ অর্থবছর হতে ২০০৯-১০ অর্থবছর পর্যন্ত সকল সাধারণ আপত্তি নিষ্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু পূর্বের যেসব কর্মচারীর অডিট আপত্তিকৃত টাকা তার পেনশন/গ্র্যাচুইটি হতে কর্তন বা স্থগিত করে পেনশন কেইস নিষ্পত্তি করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে তা ফেরত দেওয়ার নির্দেশনা নাই। এ জন্য ওই কর্মচারী গ্র্যাচুইটির টাকা পাবেন না। কেননা, তার পেনশন কেইস ২০২১ সালে সরকারের এই নির্দেশনা জারি হওয়ার আগেই নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।’
মন্তব্য করুন