চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণের মেহারন দালাল বাড়িতে একসাথে থাকে ৩৬০ পরিবারের ৭ হাজারেরও বেশি সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষ। প্রায় ২ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে অবস্থিত এ বাড়িটি হচ্ছে নায়েরগাঁও ইউনিয়নে। যেখানে ৬ হাজারেরও বেশি ভোটার সংখ্যার অধিকাংশই জেলে সম্প্রদায়ের। শুক্রবার (১৫ ডিসেম্বর) সকালে দালাল বাড়িতে গেলে তারা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
সরজমিনে দেখা যায়, দালাল বাড়ির ভেতরে প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সহশিক্ষাকেন্দ্র এবং ছোট বড় একাধিক সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় রয়েছে। সেখানে রয়েছে জগন্নাথদেবের একটি মন্দির এবং একটি ইসকন মন্দির। যেখানে প্রতিবছরই লক্ষ্মীপূজায় লক্ষ্মীর দশেরা অনুষ্ঠিত হয়। বাড়িটিতে যাওয়ার জন্য আগে নৌকা ছিল একমাত্র বাহন। এখন কাজিয়ারা বাজার থেকে একটি রাস্তা পাকার কাজ চলছে। তবে সময়ের ব্যবধানে রাস্তা নির্মাণের কারণে এখন উন্নয়নের ছোঁয়া পড়ছে। পুরো বাড়িটি ঘিরে ১টি স্বর্ণের দোকান, ৪টি সেলুন, ২টি ফার্নিচারের দোকান, ২টি মোবাইল সার্ভিসিং, ৪টি মুদি দোকান রয়েছে এবং স্কুল সংলগ্ন ছোট বাজারও রয়েছে। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ সহজ সরল হওয়া সত্ত্বেও এবং শিক্ষার হার কম হলেও রয়েছে ডাক্তার, উকিল, ইন্জিনিয়ারসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই এখন সরকারি চাকরি করেন। এখানে একাধিক এনজিও সংস্থা নিরলস কাজ করলেও তেমন উন্নতি হয়নি।
স্থানীয়রা জানান, দালালবাড়ির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম হচ্ছেন বৈকুণ্ঠ দালাল, দ্বারিকানাথ দালাল, প্যারিমোহন দালাল ও নবদ্বীপ দালাল। ঘনবসতিপূর্ণ এই বাড়ির সবাই সনাতন ধর্মের এবং পেশায় জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ী। বাড়ির বাসিন্দারাই নিজেদের মধ্যে নির্বাচিত করেন একজন ওয়ার্ড মেম্বার। বর্তমানে এই গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ভরত চন্দ্র দাস। নির্বাচনে ঝুলে থাকে চেয়ারম্যানের ভাগ্যও।
তারা আরও জানান, মেহারন দালাল বাড়িতে বর্তমানে তৃতীয় প্রজন্ম বসবাস করছে। বাড়ির আশপাশে নেই অন্য কোনো বাড়ি। বর্ষায় ফসলি জমিগুলো পরিণত হয় বিলে। মনে হবে ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি বিলের মাঝখানে অবস্থিত বাড়িটি। ডাকাতিয়া শাখা নদীর পাড়ে এর অবস্থান। এক বাড়িতে একসাথে বসবাস করলেও তাদের মধ্যে নেই কোনো হিংসা, লোভ বা শত্রুতা। যুগের পর যুগ এভাবেই তারা কাটিয়ে দিচ্ছেন।
বৈকুণ্ঠ দালালের উত্তরসূরি সুভাষ চন্দ্র দাস বলেন, এখানে জমিদারদের বসবাস ছিলো। এ গ্রামের নেতৃত্বে ছিলেন মায়াধর। তার পিতার নাম মনমোহন দালাল। দ্বারিকানাথ দালাল এখানকার জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। মূলত তারই স্মৃতিই বহন করছে গ্রামটি।
মেহারন দালাল বাড়ির বাসিন্দা সনজিৎ দাস, ও সঞ্জয়সহ বেশ কয়েকজন বলেন, একটি বাড়িতে তাদের একত্রে থাকতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তাদের মাঝে যদি কখনো কোনো সমস্যা দেখা দেয়। বাড়ির যারা বয়োজ্যেষ্ঠ রয়েছেন তারাই সমাধান করেন। বাইরের কাউকে তাদের প্রয়োজন হয় না। মাঝে মাঝে ঝগড়া-বিবাদ হলেও এভাবেই একত্রে তারা কাটাতে চান।
দালাল বাড়ির জয় বলেন, এই বাড়িটিতে নেই হাঁটার রাস্তাটুকুও। একটি ঘরের সঙ্গে আরেকটি ঘর। শুধু এই বাড়িকে কেন্দ্র করে এমপিওভুক্ত হাইস্কুল থাকলেও ক্লাসরুম এবং ভবনের অভাবে পাঠদানের সমস্যারও অন্ত নেই।
স্কুলটি বেহাল দশার কথা জানাতে স্থানীয় দোকানি সঞ্জয় ও বাসিন্দা ইন্দ্রজিৎ বলেন, স্কুলটি পরিচালনার জন্য আমরা নিজেরাই সাধ্যমতো সহযোগিতার ফলে কিছু ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার খানিকটা সুযোগ হয়। তাই নাগরিক সুবিধা পেতে দ্রুত স্কুল উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।
বাড়ির বাসিন্দা রাজিব দাস, সুমন দাস, কৃষ্ণসহ কয়েকজন বলেন, বাড়ির সবাই একত্রে থাকলেও এ বাড়ির বড় সমস্যা দুইটি। একটি বাড়ির অভ্যন্তরীণ পরিবেশ এবং অপরটি স্কুল নামে থাকলেও অস্তিত্ব বিলুপ্তির পথে। তাদের দাবি বাড়ির ভেতরে রিকশা বা সিএনজি কিংবা কোনো গাড়ি ঢুকতে না পারায় অনেক ভোগান্তিতে তাদের পড়তে হচ্ছে। অসুস্থ রোগীদের নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে অনেক বেগ পেতে হয়।
বৈকুণ্ঠ দালালের উত্তরসূরি সুভাষ দাস বলেন, আমরা খুশি হব আমাদের বাড়ির রাস্তাঘাটগুলো প্রশস্ত হলে। এখন আমাদের চলাফেরা করতে সমস্যা হয়।
এই বাড়ির গৃহবধূ মালতী রানি জানান, ভোটের সময় সবাই ভালো কথা বললেও তাদের গ্রামের উন্নয়নে কেউ কিছু করে না। বাড়িটির নামকরণ ইতিহাস সম্পর্কে বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা তেমন কিছু জানেন না। শুধু জানেন একসময় এখানে জমিদার বংশের লোক বসবাস করত। তাদের আশ্রয়ে সৃষ্টি হয় এই বাড়ি। জমিদারদের দোতলা দুটি ভবন এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটিতে। একটি ভবনের নাম দ্বারকাপুরি এবং অপরটির নাম আম্বিকা ভবন। ভবনগুলো যথাক্রমে নির্মাণ করা হয় ১৩৩৫ ও ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের দিকে।
নায়েরগাঁও দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম মামুন বলেন, মেহারন দালালবাড়ির ঐতিহ্য রয়েছে। এ বাড়ি নিয়েই একটি ওয়ার্ড। সবাই সনাতন ধর্মাবলম্বী। পেশায় অধিকাংশই মৎস্যজীবী ও নিরীহ। আমরা সব সময়ই তাদের পাশে আছি। বাড়ির অভ্যন্তরীণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে বাড়ির বাসিন্দারা যদি একত্রিত হয়ে আমাদের কাছে আসে। তাহলে আমাদের পরিষদের পক্ষ থেকে সকল প্রকার সহযোগিতা করা হবে। স্কুলের সমস্যাটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সরকারিভাবে পরবর্তীতে কোন বাজেট আসলে এটি প্রধান কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে।
এ বিষয়ে চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বি এইচ এম কবির আহমেদ বলেন, দালাল বাড়িটি সারা দেশের মধ্যে অনন্য। এই বাড়িতে আগে অনেক সমস্যা নিয়ে মানুষ বসবাস করত। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই নতুন করে রাস্তাটি পাকা করায় তাদের জীবনমানে অনেকটা পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। এছাড়াও যদি তাদের আরও কিছু প্রয়োজন হয় তাহলে তা করে দেয়ার উদ্যোগ নেব।
মন্তব্য করুন