দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতীক হাতে পাওয়ার পর পরই প্রার্থীদের ১৯ দিনের প্রচারণার কাজ শুরু হওয়ায় ব্যস্ততা বেড়েছে প্রেস, মাইক ও ব্যানারের দোকানগুলোতে। নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেওয়া প্রচারবিধি মাথায় রেখে প্রার্থী ও কর্মী সমর্থকদের সাথে সমন্বয় রেখে ভালো কাজ উপহার দিতেই এই ব্যস্ততা চালাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কারিগররা।
মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) সকালে শহরের প্রেস, মাইক ও ব্যানারের দোকানগুলোতে গেলে তাদের নির্বাচনী প্রচারকাজে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়।
তথ্য মতে, চাঁদপুর জেলায় ৬১টি প্রিন্টিং প্রেস বা ছাপাখানা রয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগই ডিজিটাল ও অফসেট প্রেস। এর মধ্যে চাঁদপুর শহর ও সদরে ১৭, হাজীগঞ্জে ১৩, শাহারাস্তিতে ২, ফরিদগঞ্জে ৪, কচুয়ায় ৭, মতলব দক্ষিণে ৪ এবং মতলব উত্তর ও হাইমচরসহ বিভিন্নস্থানে ছোটবড় আরও ১৪টি প্রেস গেল ৫ বছরে গড়ে উঠেছে। যদিও মাইক এবং ব্যানারের দোকানের নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। এসব প্রচার মাধ্যমগুলো থেকে প্রতীকসহ প্রার্থী চিনেই চাঁদপুরের ৫টি আসনের ৭০০ ভোটকেন্দ্রে ২১ লাখ ৫৬ হাজার ৬০৯ জন ভোটার মোট ২৯ জন প্রার্থী থেকে পছন্দের ৫ জন প্রার্থীকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে আগামী ৫ বছরের জন্য নিজেদের সেবা করার জন্য ভোটের মাধ্যমে বেছে নিবেন।
চাঁদপুর জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদ বলেন, এবারের নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রচার শেষ হবে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টায়। এই হিসেবে প্রার্থীরা প্রচারের সময় পাচ্ছেন দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় অর্থাৎ পুরো ১৯ দিন। এ সময়ে বেশ কিছু নিয়ম প্রচারে তাদের অনুসরণ করতে হবে। তার মধ্যে হলো পোস্টার রঙিন করা যাবে না। ৪০০ বর্গফুটের বেশি বড় কোনো প্যান্ডেল করে এলাকায় প্রচার চালানো যাবে না। কাপড়ের তৈরি ব্যানার করে প্রচার চালানো গেলেও ডিজিটাল ডিসপ্লে ব্যবহার করা যাবে না। মাইকে প্রচার দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। পোস্টারের সাইজ দৈর্ঘ্যে ৬০ সেন্টিমিটার ও প্রস্থে ৪৫ সেন্টিমিটার এবং ব্যানার কোনোভাবেই তিন মিটারের বেশি করা যাবে না। প্রচারের অংশ হিসেবে যে কোনো প্রকার দেয়াল লিখন, পোস্টানো সাঁটানো দণ্ডনীয় অপরাধ। অর্থাৎ এ ধরনের আরও যেসব আইন রয়েছে সে নিয়ম মেনেই প্রার্থীরা প্রচারণার কাজ চালাতে পারবেন।
শহরের সায়াবানী এলাকার আর্ট সাইনের পরিচালক মো. কামাল বেপারি বলেন, কাগজের দাম বেড়ে গেছে। তাই আমাদের পোস্টারে ব্যবহৃত ৬৫ গ্রাম কাগজের দাম এক রিম ৩ হাজার টাকা রাখতে হয়। যা আগে ছিল ১৭শ টাকা এবং এক রিমে এক হাজার পোস্টার ৪৫শ টাকা ধরে নির্বাচনী প্রচারণার কাজে ব্যস্ত সময় পার করতে হচ্ছে।
চাঁদপুর অফসেট প্রেসের কর্ণধার মো. মিলন বলেন, ছাপাকাজের কাগজগুলো আমাদের বিভিন্ন কোম্পানির ডিলার ও সাব-ডিলারদের থেকে সংগ্রহ করতে হয়। তবে বর্তমান সময়ে কাগজ, কালিসহ অন্য জিনিসের দাম বেড়েছে। দেড় বছরের ব্যবধানে কাগজের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। বর্তমানে প্রতি রিম (৫০০ পিস) বড় সাইজের (২৩ ইঞ্চি বাই ৩৬ ইঞ্চি) ৫৫ গ্রাম পুরুত্বের দাম ২ হাজার ৩০০ টাকা, যা আগে ছিল ১ হাজার ৩০০ টাকা। এই কাগজ কিনে কাটিং মেশিনের সাহায্যে সাইজ করে তা দিয়ে পোস্টার ছাপানো হয়। বেড়েছে কালির দামও। দেড় বছর আগে কোম্পানি ভেদে প্রতি পাউন্ড কালির দাম ছিল ১০০-১৫০ টাকা। এখন তা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৪৫০-৫০০ টাকায়। এগুলো মাথায় রেখেই আমাদের ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।
চাঁদপুর এস আর কালার ল্যাবের মালিক কাজী মিজানুর রহমান বলেন, ছাপার কাজের জন্য অফসেট মেশিনের এক্সপোজ মেশিন (প্লেট মেশিন), কালি রোল, প্লেট বাধা সিলিন্ডার, ছাপা সিলিন্ডার, কালি ও মবিল স্টোর, পানির স্টোর, হাওয়া সিলিন্ডার, চেইনসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ পরিষ্কার রাখা খুবই জরুরি। সাধারণত কম্পিউটারে ডিজাইন তৈরি করে এক্সপোজ মেশিনের সাহায্যে প্লেটে ডাইস (ছাপ) তৈরি করা হয়। এরপর তা প্লেট সিলিন্ডারে দিয়ে প্রিন্ট করা হয়। আকার ভেদে একটি মেশিনে প্রতি মিনিটে ৭০ থেকে ১২০ পিস পোস্টার প্রিন্ট দেওয়া সম্ভব। এক হাজার পোস্টার ছাপালে গড়ে ৩০০ টাকা লাভ থাকে। আমরা দুই হাজারের কম পোস্টার ছাপাই না।
শহরের মাইক ব্যবসায়ী কালু বলেন, সব দল নির্বাচনে এলে মাইকের কাজ বেশি পেতাম। এখন যে দলগুলো এসেছে তারা মাইকগুলো ভাড়া নিচ্ছে। পুরোদমে মাইকিং করতে কিছু মৌসুমি ঘোষককে আমরা প্রচারকাজে নিয়োজিত করছি। তবে কেউ যদি নিজের কর্মী সমর্থক দিয়ে উপস্থাপনা করায় তাহলে আমরা শুধু মাইকের ভাড়াটুকুই রাখি।
কার মাইকেল প্রেসের পরিচালক বিনয় ভূষণ মজুমদার বলেন, ছাপাখানায় আগের মতো ব্যস্ততা নেই। প্রার্থী এবং তার কর্মী সমর্থকরা এখন সোশ্যাল মিডিয়াকে প্রচার মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। তবে আনুষ্ঠানিকতা বজায় রাখতে কিছু পরিমাণ পোস্টার অনেকে ছাপাচ্ছে। তাই সব খরচ দিয়ে এ কাজে এখন লাভ খুব সীমিত।
চাঁদপুর প্রেস মালিক সমিতির সভাপতি ও বন্ধু মুদ্রায়নের কর্ণধার দুলাল পাটোয়ারী বলেন, কাগজপত্র গুছানো হতে শুরু করে পোস্টার তৈরির পুরো কাজ প্রসেসিংয়ে এ পেশায় বহু লোক জড়িত। সবাই চায় ভালো কাজটা গ্রাহককে পৌঁছে দিতে। তবে অনেকেই বিল বকেয়া রাখতে চায়। সে টাকা তুলতেই সমস্যা হয়ে যায় আমাদের। তারমধ্যে এবার আসনগুলোতে যেহেতু প্রতিযোগী কম। তাই কাজের প্রাণ চাঞ্চল্যেরও ধীরগতি রয়েছে। আমরা বছর শেষ হওয়ায় নতুন বছরের ক্যালেন্ডার ও প্যাড তৈরিতেই বেশি ব্যস্ত সময় এখন পার করছি।
এ বিষয়ে চাঁদপুর জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান বলেন, কোনো প্রার্থী আইনে নির্ধারিত সব নির্দেশনার বাইরে কাজ করলে ছয় মাসের জেল বা ৫০ হাজার টাকা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আর কোনো দল প্রচার নির্দেশনা না মানলে সেই দলকেও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হবে। আমরা সব বিষয়গুলোই নজরদারির আওতায় রেখে প্রার্থী ও দলের প্রচারণায় আচরণবিধি লঙ্ঘনের ব্যাপারে সজাগ রয়েছি।
মন্তব্য করুন