দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার খানপুর ইউনিয়নের রতনপুর গ্রামে অযত্ন অবহেলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে ঐতিহাসিক নিদর্শন। প্রায় তিন বছর আগে উপজেলা প্রশাসন এটি সংস্কার ও প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরের অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন জানায়। তবে এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। ভগ্নদশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দোতলা ভবনটি। পুরোনো ইটের দেয়ালে অসংখ্য পরগাছা। ঘরের ভেতরে ময়লা-আবর্জনা। ব্রিটিশ আমলের জমিদার বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত। এর প্রধান ফটক থেকে শুরু করে ঘরের দরজা ও জানালার কাঠামো আছে। নেই কোনো কপাট। সেখানে গরু-ছাগল আর বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ।
উপজেলা সদর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে এই জমিদার বাড়ির অবস্থান। সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, জমিদারবাড়ির সীমানা প্রাচীর নেই। বাড়ির চত্বরে গরু চরে বেড়াচ্ছে। দরজা জালানার কাঠামো রয়েছে। তবে কোনো কপাট নেই। দোতলায় পশ্চিমের ঘরে শুকনো পাতা ও কাগজ পোড়ানোর চিহ্ন। নিচ তলা থেকে ছাদের বেষ্টনী দেয়াল পর্যন্ত ইট তুলে নেওয়া হয়েছে। বাড়িটির ছাদের নিচের অংশে রয়েছে লোহার গার্ডার। ইট, সুরকি ও রড দিয়ে নিপুণ গাঁথুনির এ দ্বিতল ভবনে রয়েছে ১৪টি ঘর। ঘরের ভেতর ও ছাদে রয়েছে প্রাচীন ঐতিহ্যের অনেক নিদর্শন।
এই জমিদারবাড়ি সম্পর্কে লিখিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে শেষ জমিদার যার নামে এই বাড়ি পরিচিত, সেই রুক্ষনি কান্ত সরকারের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল খানপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান আবদুর রউফ (৮০)। কালবেলাকে তিনি জানান, ব্রিটিশ আমলে ভারতের বাঁকুড়ার জমিদার প্রমোদ চন্দ্র মুন্সি খাজনা আদায়ের জন্য রাজকুমার সরকারকে বিরামপুরে পাঠান। কয়েক বছর পর ১৯৩৫ সালে ওই জমিদারের কাছ থেকে রাজকুমার সরকারসহ কয়েকজন বিভিন্ন মৌজায় জমির বন্দোবস্ত নেন। রাজকুমার সরকার অঢেল সম্পত্তির মালিক হন। পরে ১৯৪২-১৯৪৩ সালে তিনি ওই বাড়িটি নির্মাণ করেন। রাজকুমার সরকার মারা যান ১৯৪৫ সালের দিকে। বাবার মৃত্যুর পর সম্পত্তির উত্তরাধিকার হন রুক্ষুনি কান্ত সরকার।
আবদুর রউফ আরও বলেন, ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে জমিদার রুক্ষিনি কান্ত সরকার তার স্ত্রী কণিকা রানি সরকারকে নিয়ে কলকাতার বাড়িতে চলে যান। পরে ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে তিনি দেশে আসেন। এ সময় তিনি তার প্রায় ১৩০০ বিঘা জমি বাংলাদেশ সরকারের কাছে রিটার্ন সাবমিট করেন এবং পরের দিন কলকাতায় ফিরে যান। এরপর থেকে স্থানীয় অধিবাসীরা ওই জমি ভোগদখল করতে থাকেন। এর মধ্যে প্রায় ৪০০ বিঘা জমি অর্পিত সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত হয়। পরে তৎকালীন খানপুরের তহশিলদার ওই জমিগুলো ১ নম্বর খাস খতিয়ানে রেকর্ড করেন। ১৯৭৪ সাল থেকে বাড়িটি খানপুর ইউপি অফিস ও ১৯৮০ সাল থেকে খানপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ২০১৯ সালে জমিদার বাড়ি সংলগ্ন উত্তর পাশে ভূমি অফিসের নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়। তখন থেকেই বাড়িটি ঝুঁকিপূর্ণ ও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
জমিদারবাড়ি দেখতে আসা মহিলা ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মশিহুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘ছুটির দিনে জমিদারবাড়ি দেখতে এসেছি। বাড়িটির কাজ অনেক সুন্দর। তবে, ভেতরের পরিবেশ খুবই নোংরা। কর্তৃপক্ষ এটি সংস্কারের উদ্যোগ নিলে অনেক পর্যটক ও শিক্ষার্থী আসবেন। তারা জমিদারবাড়ির ইতিহাস জানার সুযোগ পাবেন।’
খানপুর ইউনিয়ানের চেয়ারম্যান চিত্ত রঞ্জন পাহান বলেন, ব্রিটিশ আমলের জমিদার বাড়িটি রতনপুরের ইতিহাস ও ঐহিত্যের নিদর্শন। সরকারি উদ্যোগে এটি সংরক্ষণ করা দরকার। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানাতে এই উদ্যোগ ভূমিকা রাখবে।
বিরামপুরের ইউএনও নুজহাত তাসনিম আওন বলেন, জমিদারবাড়িটির প্রত্মতাত্ত্বিক ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। এটি সংস্কারের জন্য ২০২০ সালে প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরে একটি আবেদন পাঠানো হয়েছে। পাঁচ মাস আগে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বিরামপুরে এসেছিলেন। তাকে বিষয়টি আবারও জানানো হয়েছে। প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরের অনুমতি পাওয়া গেলে বাড়িটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন