ওয়াহিদুর রহমান রুবেল, কক্সবাজার প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৩:৩৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় সহস্রাধিক রোহিঙ্গা-চাকমা

বাংলাদেশের সীমান্তে বিজিবির পাহারা চৌকি। পুরোনো ছবি
বাংলাদেশের সীমান্তে বিজিবির পাহারা চৌকি। পুরোনো ছবি

দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিদ্রোহী ও সরকারি বাহিনীর চলামান সংঘাত। গত শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) থেকে নতুন করে শুরু হওয়া সংঘাত-সংঘর্ষ থামছেই না। দুই বাহিনীর গোলাগুলি ও মর্টার শেলের বিকট শব্দে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে পুরো সীমান্তজুড়ে।

সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে বিদ্রোহীদের অবস্থান লক্ষ্য করে হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া হচ্ছে গুলি ও মর্টার শেল। গুলির মুহুর্মুহু শব্দে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় ঘর ছেড়েছে ঘুমধুম ইউনিয়নের তিন গ্রামের মানুষ। এরইমধ্যে দুপুরে মিয়ানমার থেকে ছুটে আসা একটি মর্টার শেলের আঘাতে নিহত হয়েছেন স্থানীয় জলপাইতলী গ্রামের গৃহবধূ ও এক রোহিঙ্গা। এ সময় আহত হয়েছে এক শিশু।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান অস্থিরতায় টেকনাফ হোয়াইক্যং উলুবুনিয়া সিমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় এক রোহিঙ্গা পরিবারকে আটক করেছে বিজিবি। এর আগে মিয়ানমার বিদ্রোহীদের প্রচণ্ড গোলাগুলির মুখে টিকে থাকতে না পেরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় ৯৫ জন মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সদস্য। তাদের মধ্যে আহত ৯ জনকে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। চলমান পরিস্থিতিতে সীমান্তের ওপারে বসবাস করা মিয়ানমারের চাকমা জাতি এবং রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় জড়ো হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে বিজিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সীমান্তে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সতর্ক অবস্থানে রয়েছে তারা।

এদিকে সীমান্তে মর্টার শেলের আঘাতে দুজন নিহত হওয়ার ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়েছে বিজিবি। বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবাদ জানানোর কথা জানিয়েছেন রিজওয়ান কমান্ডার।

সোমবার মর্টার শেলের আঘাতে নিহতরা হলেন, নাই্ক্ষ্যংছড়ির ধুমধুম তুমব্রু জলপাইতলী এলাকার বাসিন্দা হোসনে আরা (৫৫) এবং উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৮/ই এর ডি ব্লকের বাসিন্দা মৃত ধলু হোছেনের ছেলে নবী হোছন (৬০)। নুসরাত মনি (৬) স্থানীয় শহিদুল ইসলামের মেয়ে। নিহতরা চাষের জমিতে কাজ শেষে দুপুরের খাওয়ার জন্য বাড়িতে অবস্থান করছিলেন বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা।

তথ্য মতে, মিয়ানমারের আরকান রাজ্য স্বাধীনের নামে সরকারি বাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে আসছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান আর্মি। প্রতিদিন মিয়ানমারের অভ্যন্তরে কোনো কোনো এলাকায় চলছে দুই বাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ। ইতোমধ্যে আরকান রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল দখলেরও দাবি করেছে আরকান আর্মি। দুপক্ষের চলমান সংঘর্ষে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ধুমধুম ইউনিয়ন এবং উখিয়ার পালংখালী ও টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের সীমান্তে বসবাসকারীদের মাঝে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে মর্টাল শেল ও গুলির আঘাতে হতাহতের ঘটনায় আতংক ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। রোববারের প্রচণ্ড সংঘর্ষের রেশ কাটতে না কাটতে সোমবার সকাল থেকে তুমব্রু সীমান্ত, টেকনাফের উলুবুনিয়া ও উখিয়ার পালংখালীর বটতলী সীমান্তে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। আকাশপথে হেলিকপ্টার থেকে বিদ্রোহীদের লক্ষ্য করে ছোড়া হচ্ছে গুলি। এ পরিস্থিতে মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশের জন্য হাজারো রোহিঙ্গা সীমান্তের ওপারে অবস্থান করছে। সোমবার সকালে অনুপ্রবেশের সময় উলুবুনিয়া সীমান্ত থেকে এক রোহিঙ্গা পরিবারকে আটক করেছে বিজিবি। শুধু রোহিঙ্গা নয়, বিদ্রোহীদের ভয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে পারে মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) এর সদস্যরা। ইতোমধ্যে তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে ৯৫ জন বিজিপি সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।

ধুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের ২নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য দীল মোহাম্মদ জানান, প্রশাসনের পক্ষ থেকে সীমান্তে বসবাসকারীদের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে গোলাগুলির আতংকে ইউনিয়নের ৩ গ্রামের সহস্রাধিক মানুষ বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। সোমবার মর্টার শেলের আঘাতে দুজন নিহত হওয়ার পর স্থানীয়দের মাঝে আতংক আরও বেড়েছে বলে জানান তিনি।

মর্টার শেলের আঘাতে নিহতদের মরদেহগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুর মান্নান। তিনি বলেন, সীমান্তের ওপারে গোলাগুলি চললেও আমার দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। তবে সীমান্তে বসবাসকারীদের সরানোর বিষয়টি উপজেলা প্রশাসন বলতে পারবেন।

টেকনাফ হোয়াইক্যং উলুবুনিয়া এলাকার জালাল আহমেদ বলেন, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মিয়ানমারের ওপারে ব্যাপক গোলাগুলি এবং বোমার শব্দ আমরা শুনতে পাচ্ছি। ভয়ে সীমান্ত থেকে লোকজন সরে যাচ্ছে। অনেকে ঘর থেকে বের হচ্ছে না। প্রায় ১১টার দিকে স্ত্রী ও তিন সন্তানসহ বাংলাদেশে প্রবেশের সময় এক রোহিঙ্গা পরিবারকে আটক করেছে বিজিবি।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, সীমান্তে উত্তেজনা ওপার থেকে রোহিঙ্গা এবং বিজিপি সদস্যরা পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে পারে এমন আশঙ্কায় সীমান্তে বিজিবি সদস্যরা সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। সাগরে কোস্টগার্ড সদস্যরাও রয়েছে। কোনো অবস্থায় আমরা রোহিঙ্গা কিংবা অন্য কাউকে ঢুকতে দিব না। সকালে রোহিঙ্গা পরিবারের অনুপ্রবেশের বিষয়টি আমি এখনো অবগত নই।

এর আগে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘর্ষের বিদ্রোহীদের হামলায় টিকতে না পেরে রবিবার ভোর রাতে এবং সোমবার সকাল পর্যন্ত কয়েক দফায় ৯৫ জন বিজিপি সদস্য বাংলাদেশে প্রবেশ করে তুমব্রু সীমান্তের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। বিজিবি তাদের নিরস্ত্রীকরণ করে নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছে।

তাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ ৯ জনকে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে বিজিবির পাহারায় কঠোর নিরাপত্তায় চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। তাদের মধ্যে রবিবার রাতে দুজন এবং সোমবার সকালে সাতজনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। হাসপাতালে কঠোর নিরাপত্তায় তাদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না গণমাধ্যম কর্মীদের।

কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) মো. আশিকুর রহমান বলেন, মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির দুই সদস্যকে আহত অবস্থায় গেল রাত ৮টার দিকে হাসপাতালে আনা হয়। আজ সকালে আরও সাতজনকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। আমরা তাদের সেবা দিচ্ছি। রোববার রাতে বিজিপির চিকিৎসাধীন ওই দুই সদস্য হলেন, রি লি থাইন (২২) ও জা নি মং (৩০)। বাকি সাতজনের নাম এখনো পাওয়া যায়নি।

টেকনাফ ২ বিজির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, সীমান্তে আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি।

৩৪ বিজিবি কক্সবাজার রিজিয়ন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মাশরুকী বলেন, কোনো অবস্থায় মিয়ানমারের কোনো নাগরিককে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।

বিজিবি কক্সবাজার রিজিওয়নের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোরশেদ আলম বলেন, মিয়ানমার অভ্যন্তরে চলা সংঘাতের কারণে মিয়ানমার বিজিপি আমাদের কাছে আশ্রয় চাইলে আমরা সদর দপ্তরে অনুমতিক্রমে ৯৫ জন বিজিপির সদস্যদের আশ্রয় দিয়েছি। তাদের মিয়ানমার হস্তান্তর করার জন্য পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করতেছে। যে সাতজন আহত বিজিপি সদস্য রয়েছেন তাদের আমরা চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেছি। জলপাইতলীতে দুজন সাধারণ নাগরিক নিহতের ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা এ ব্যাপারে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানিয়েছি মিয়ানমার সরকারকে।

কক্সবাজার রোহিঙ্গা ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উচিত আরকান রাজ্যে আটকে পড়া চাকমা ও রোহিঙ্গাদের সাহায্য করা। যুদ্ধক্ষেত্রে আন্তর্তজাতিক সংস্থাগুলোর বিশেষ করে রেডক্রস, ডব্লিউএইচও, ডব্লিউএফওসহ সব সাহায্য সংস্থাগুলো সহযোগিতা করে থাকে। কিন্তু মিয়ানমারের ক্ষেত্রে সহযোগিতা না করে বাংলাদেশে স্থান দেওয়ার কথা বলে। অনেক সময় বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। এটি অবান্তর। তারা চাইলে রাখাইনে চলমান পরিস্থিতিতে আটকে পড়া মিয়ানমার নাগরিকদের খাদ্য ও চিকিৎসাসেবা দিতে পারে আমাদের ওপর চাপ প্রয়োগ না করে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সুয়ারেজের দুই পেনাল্টিতে মেসিবিহীন মায়ামির রোমাঞ্চকর জয়

গাজায় নতুন ধাপে ‘গণহত্যা’ শুরু করল ইসরায়েলের সেনাবাহিনী

ডিমলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স  / ওষুধ-চিকিৎসকের সংকটে ভোগান্তিতে রোগীরা

পাকিস্তানের হুমকির পর ‘অগ্নি ৫’ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ভারত

সরকারি সফরে চীন গেলেন সেনাপ্রধান 

সাগরে ভাসমান ১৩ জেলে উদ্ধার, নিখোঁজ ৬

হবিগঞ্জে সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনে ভয়াবহ আগুন

অ্যাপলের আগে সারপ্রাইজ ‍দিল গুগল

ভয়াবহ আগুনে তুলার মিল পুড়ে ছাই

২১ আগস্ট : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১০

দুপুরের মধ্যে যেসব জেলায় হতে পারে বজ্রবৃষ্টি

১১

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে প্রাইভেটকার উল্টে নিহত ৩

১২

বৃহস্পতিবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৩

২১ আগস্ট : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৪

৪ দিনের সফরে ঢাকায় পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী

১৫

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে বাড়ল বাস ভাড়া

১৬

পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গড়ে তোলা হবে ক্লিন সিটি : চসিক মেয়র

১৭

জুলাই সনদে মিত্রদের ‘কাছাকাছি মতামত’ দেওয়ার পরামর্শ বিএনপির

১৮

সন্তানকে বাঁচিয়ে প্রাণ দিলেন বাবা

১৯

সৈকতে ফের ভেসে এলো মৃত ইরাবতী ডলফিন

২০
X