জমিদখল, সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ, প্রতিপক্ষকে নির্যাতন, কমিশন বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে সাভার উপজেলার বনগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে।
অতিদরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান আরিফ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের পদে বসে মাত্র আড়াই বছরেই বনে গেছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক। ব্যবহার করেন বিলাসবহুল গাড়িও।
অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতা হওয়ার পর থেকেই জবরদখল, বিভিন্ন অপরাধ নিয়ন্ত্রণসহ নিজস্ব লোকজন নিয়ে এলাকায় শুরু করেন আধিপত্য বিস্তার। তার ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে দুর্ধর্ষ বাহিনী। এলাকাবাসীর কাছে যা আরিফ বাহিনী হিসেবে পরিচিত। এই বাহিনীর মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণে রাখেন পুরো ইউনিয়নের অধিপত্য।
আরিফের এসব কর্মকাণ্ডের সম্মুখে থাকেন বনগাঁও ইউনিয়ন ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, সৌরভ ও সাধারণ সম্পাদক সুজন মাহমুদ। ২০২১ সালে কমিটি বিলুপ্ত করার পর এখনও নিজেদের স্বপদে বহালের দাবি করে রাজনীতিতে সক্রিয় তারা। আরিফের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় অনুসারী নেতাকর্মীদের নিয়ে দাপিয়ে বেড়ান ছাত্রলীগের মেয়াদোত্তীর্ণ এই দুই নেতা। তাদের মাধ্যমেই দখল বাণিজ্য, আধিপত্য বিস্তার, প্রতিপক্ষের লোকদের নির্যাতন করেন আওয়ামী লীগ নেতা আরিফ।
এদিকে প্রায় তিন বছর ধরে ইউনিয়ন ছাত্রলীগের কমিটি না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন খোদ সাভার উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি অতিকুর রহমান আতিক।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দরিদ্র কৃষক মৃত আব্দুল হালিমের ছেলে আরিফুল ইসলাম বনগাঁও ইউনিয়নের বেড়াইদ গ্রামে নির্মাণ করছেন বিলাসবহুল বহুতল ডুপ্লেক্স বাড়ি। নান্দনিক নকশা ও কারুকার্যে বাড়িটি নজর কাড়বে যে কারও। বাড়ির পাশেই কয়েক একর সরকারি খাস জমি দখল করে বালু ভরাট করছেন আরিফ। অনুমোদনহীন নিশান হাউজিং কোম্পনির নামে বালু ভরাট করে বিভিন্ন সরকারি খাস সম্পত্তি ও আশপাশের কৃষি জমি দখলের পাঁয়তারা করছেন এই প্রভাবশালী নেতা। বিষয়টি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে সাংবাদিকদেরও বাধা দেয় দখলদার আরিফ বাহিনীর কয়েকশ লোকজন।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে কমিশন বাণিজ্যের। সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প, রাস্তাঘাট নির্মাণসহ ইউনিয়নে যে কোনো কাজের জন্য আরিফকে দিতে হয় মোটা অঙ্কের কমিশন। কমিশন না দিলে রাস্তা কিংবা প্রকল্পের নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয় আরিফের লোকজন। সরকারি রাস্তা নির্মাণের জন্য আনা ইট নিজের হাউজিং কোম্পানির মাধ্যমে আত্মসাতের অভিযোগও তার বিরুদ্ধে। জমি ক্রয়-বিক্রয় করতে গুনতে হয় কমিশন। বাড়ি নির্মাণ কিংবা বড় পরিসরে ব্যবসা করতে হলেই দিতে হয় চাঁদা।
বনগাঁও ইউনিয়নে ভেকু দিয়ে ফসলি জমির মাটি কেটে নেয় আরিফের লোকজন। বারবার এ বিষয়ে প্রতিবাদ করেও কোনো প্রতিকার মিলছে না স্থানীয় কৃষকসহ ভুক্তভোগী জমি মালিকদের। পার্শ্ববর্তী ইটভাটায় এসব মাটি বিক্রির ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় আরিফের ছাত্রছায়ায় সক্রিয় বেশ কয়টি চক্র নিয়মিত মাটি কেটে নিচ্ছে ফসলি জমি থেকে। এতে স্থায়ীভাবে নষ্ট হচ্ছে বিস্তীর্ণ ফসলের জমি।
প্রতিনিয়ত বনগাঁও ইউনিয়নে ঘটছে হামলা, মারামারি ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা। পাড়া-মহল্লায় সহজেই মিলছে বিভিন্ন মাদক। এসব অপরাধসহ মাদক ক্রয়-বিক্রয়ে জড়িতদের অনেকেই এলাকায় আরিফের লোক হিসেবে পরিচিত। নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে কয়েকটি বখাটে কিশোর গ্যাং চক্রকেও হাতে রাখেন আরিফ। তাদের বিষয়ে অভিযোগ জানালে উল্টো ভুক্তভোগীদের হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। আরিফের অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় এক প্রবাসীর বাড়িতে ছাত্রলীগ নেতা সৌরভ ও সুজনের নেতৃত্বে ভাঙচুর চালায় আরিফের লোকজন।
নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিশান হাউজিং কোম্পানি থেকেও বিপুল অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতির অভিযোগ আরিফের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে অপর অংশীদারদের ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক বসেন চেয়ারম্যান পদে। জমির দ্বিগুণ মূল্য দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, ব্যয়সংক্রান্ত অসংগতি, মূল্য নির্ধারণে অনিয়ম, কোম্পানির অর্থ আত্মসাৎ, ষড়যন্ত্র করে জমি বিক্রয়ে বাধ্য করাসহ বিভিন্ন অনিয়মের সত্যতা মিললে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয় দায়িত্ব থেকে। পুনরায় জোরপূবর্ক চেয়ারম্যান পদ দখল করেন আরিফ। তার অর্থ লোপাট ও দুর্নীতির যাবতীয় প্রমাণাদি রয়েছে কালবেলার হাতে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিশান হাউজিং কোম্পানির অংশীদার দেলোয়ার হোসেন বলেন, জোরপূর্বক চেয়ারম্যান পদে বসে থাকা আরিফ আমাদের কোম্পানি থেকে প্রায় ছয় কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। আমরা সব অংশীদার মিলে তার বিরুদ্ধে আইনগতভাবে ব্যবস্থা নেব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউনিয়নের প্রবীণ এক আওয়ামী লীগ নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে ২০২১ সালে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সম্মেলনে আরিফের মতো বিতর্কিতকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। সম্প্রতি তার কর্মকাণ্ডে আমরা আরও বেশি বিব্রত।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বনগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম বলেন, এই অভিযোগগুলো সত্য না। অবৈধ অর্থ আমি ইনকাম করিনি।
জমিদখলের বিষয়ে বলেন, ‘খেলার মাঠের জন্য সরকারি জমিতে আমি বালু ভরাট করছি।’
মন্তব্য করুন