দিনাজপুরের বিরামপুরে উপজেলা সীমান্তের ওপার থেকে আসছে ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন, নেশা জাতীয় ইনজেকশন। ভারতের সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে এসব মাদকদ্রব্য বিরামপুরের পোস্তমপুর ফকিরপাড়ার ইয়াবা ব্যবসায়ী মোশারফের বাড়ি থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে ফুলবাড়ীসহ দেশের বিভিন্ন উপজেলায়।
প্রথমে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়। পরে মোটরসাইকেল ও অটোরিকশাযোগে পৌঁছে দেওয়া হয় এসব মাদকদ্রব্য। এতে মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে এ উপজেলা।
সেই সঙ্গে সীমান্তের ওপার থেকে ফেন্সিগ্রিপ নামক এক ফেনসিডিল, এমকে ডিল, ফায়ার ডিল নামের ওষুধ এনে দেশে ভেজাল ফেনসিডিল তৈরি করে বাজারে সয়লাভ করছে। ভিনদেশ থেকে একটি ওষুধ এনে তা বোতলে ভরে ফেনসিডিলের মোড়ক যেমন লাগানো হচ্ছে, তেমনি হোমিও ওষুধ, গ্লুকোজ ও পানি মিশিয়ে স্থানীয়রা তৈরি করছে ভেজাল ফেনসিডিল। এই নেশা শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
স্থানীয় লোকজন জানান, ভারতের ত্রিমোহিনী থেকে বালুঘাট এলাকায় বেশ কিছু কারখানা গড়ে উঠেছে নতুন একটি মাদকের। যা দেখতে অবিকল ফেনসিডিলের মতো। যদিও বোতলের গায়ে ভারতীয় ‘শিমর’ জেলার নাম উল্লেখ আছে। এ বোতলগুলোকে ভারতের হিলিতে আনা হয় তরল (খোলা) হিসেবে। পরে সেখান থেকে বেশ কয়েকটি স্থানে বোতলজাত করে দেশে ঢোকানো হয়। এ জন্য ভারতের প্রায় ৫০ জন পরিবেশক নিয়োগ করা আছে। তাদের মধ্যে ত্রিমোহিনীর দত্ত বাবু, তার ছেলে নেপাল এবং গোপাল কালিকাপুরের মোজাফফর রহমান অন্যতম। নতুন মাদকটির দাম ২০০ টাকা। সেটিই বাংলাদেশে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মাদক চোরাকারবারি জানান, ফেনসিডিলের পুরোনো খালি একটি বোতলের দাম ৫০ টাকা, নতুন একটি মুখের দাম ১৫০ টাকা, হোমিও ওষুধ ও গ্লুকোজ পানিতে মিশিয়ে ৪০ টাকাসহ ১০০ মিলিলিটার ফেনসিডিল তৈরি করতে মোট ২৪০ টাকা খরচ হয়। কিন্তু এই বোতল বিক্রি হয় দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকায়। হোমিও ওষুধটি ভারতের হিলি শহর থেকে দুই হাজার টাকা বোতল কেনা হয়। সেই একটি বোতল দিয়ে দুই হাজার বোতল ফেনসিডিল তৈরি করা সম্ভব।
স্থানীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে, ভারতীয় অংশের বলপাড়া গ্রামের আনিছুর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীরা লাইনম্যান হিসেবে কাজ করেন। তাকে সহযোগিতা করেন বলপাড়ার ইউসুফ, কালিপদ ও নিখিলচন্দ্র। উঁচা গোবিন্দপুরের স্বপন বৈরাগী, গেদলা, পার্থ, কালিপদ, উপক, দিপক এবং নিচা গোবিন্দপুরের মিঠুন, আশিক, নুর ইসলাম, ভোলা, শফিকুল, রুবেল, শাহিন, সুলতান ও আলম এগুলো বাংলাদেশে পাচার করেন। এ ছাড়া হিলি শহর, পানজুল, ত্রিমোহিনীতে বোতলের নতুন মুখ তৈরি করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মাদক কারবারি বলেন, বর্তমানে ভারত থেকে যেসব ফেনসিডিল বাংলাদেশে প্রবেশ করে তার সবই নকল। শুধু তাই নয়, চোরাকারবারিরা পানিতে হোমিও ওষুধ ও গ্লুকোজ মিশিয়ে বাড়িতে বসেই তৈরি করছেন স্বচ্ছ ফেনসিডিল।
ওসি সুব্রত কুমার সরকার আইন শৃঙ্খলা সভার বক্তব্যে বলেন, বিরামপুর থানায় যোগদানের পর মাদক ও জুয়ার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দিয়ে শতাধিক আসামি গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
উপজেলা চেয়ারম্যান খায়রুল আলম রাজু আইনশৃঙ্খলা সভায় বক্তব্যে বলেন, জুয়া এবং মাদকের জন্য কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। বিরামপুর উন্নয়নের জন্য মাদক ও জুয়ার বিরুদ্ধে কাঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পৌর মেয়র আধ্যক্ষ আক্কাস আলী আইনশৃঙ্খলা সভায় বলেন, পৌর শহরের কোথাও মাদক ও জুয়া খেলাসহ সব অপরাধ দমন করার জন্য আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অপরাধ নির্মূলের জন্য পৌর এলাকার বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে এগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে।
উপজেলা আনসার ভিডিপির কর্মকর্তা তাহেরা বেগম বলেন, বিরামপুর কেটিসি রোডে বটতলায় একটি চায়ের দোকানে শেফালি বেগম (পুনি), শামসুন্নাহার (পাতনি) দেদার ইয়াবা বিক্রি করছে। সেখানে সন্ধ্যা নামলেই মোটরসাইকেলের ভিড় দেখা যায়। এই মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স আনছারুল। সে মাদক ব্যবসায়ীদের ভয় ভীতি দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয় বলে খবর পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া ইসলাম পাড়ার বুল্লি, রেজাইল, মিনারা বেগম দেদার মাদক ব্যবসা পরিচালনা করছে বলে জানা গেছে।
কাটলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইউনুছ আলী বলেন, কাটলা হাসপাতাল মোড়, কাটলা টেম্পুস্ট্যান্ড মোড়, খিয়ার মামুদপুর, কাটলা হাড়িপাড়া, দক্ষিণ রামচন্দ্রপুর, দামোদরপুর, ময়নার মোড় এসব স্থানে বিশেষ করে সীমান্তের অপার থেকে ইয়াবা জাতীয় ট্যাবলেট সীমান্ত দিয়ে পাচার করে তা অবাধে বিক্রি করা হচ্ছে।
জোতবানী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কেটরা পাড়ার নাওয়াডাঙ্গা গ্রামের ১০-১৫ আদিবাসী চোলাইমদ তৈরি করার পর বোতলজাত করে বিরামপুর শহরের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে আদিবাসী ব্যবসায়ীরা। তারা হলেন- জুলি সরেন, ইলিয়াস সরেন, বেনজিন জয়েন্তী, রমিল, হরেন, ডিপজোলের বোন।
আদিবাসী চার্চের সাধারণ সম্পাদক আলবেরি কুচমার্ডী বলেন, চোলাই মদ তৈরি হচ্ছে চিটাগুড় ও ময়লা আবর্জনার স্তূপ থেকে। নাওয়াডাঙ্গা গ্রামের কিছুসংখ্যক আদিবাসী সন্ধ্যা হলেই প্রায় ১০-১৫টি বাড়িতে চোলাইমদ বিক্রির জমজমাট আসর বসে। এদের ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে পারে না।
স্থানীয়রা জানান- জোতবানি, শিবপুর, আয়ড়ার মোড় দেশমা,অচিন্তপুর সীমান্তসহ বিরামপুর রেলস্টেশন, কেডিসি রোড, শিমুলতলী, গড়েরপাড়, মির্জাপুর, থানার পিছনে আদিবাসীপাড়ায়, হাবিবপুর মাহমুদপুর শান্তিমোড় আদিবাসীপাড়ায় রমেশচন্দ্র এসব চোলাই মদ তৈরি করেন। এ ছাড়াও ইসলামপাড়া, স্টার সিনেমা হলের পিছনে টিকুরিপাড়া, মৎস্য খামারের পাশের (উপজেলা কারাগার), ঘোড়াঘাট রেলগুমটি এলাকায় প্রায় ৩ শতাধিক স্থানে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মাদক ব্যবসীয়া ভ্রাম্যমাণ হিসেবে খুচরা বিক্রি করে।
বিরামপুর থানার পরিদর্শক সুব্রত কুমার সরকার জানান, নিয়মিত মাদক কারবারিদের আটক করে মামলা দেওয়া হচ্ছে। অনেক স্থানে অভিযানকালে ফেনসিডিলের খালি বোতল পাওয়া যাচ্ছে। সেই থেকে ধারণা করা হচ্ছে, ফেনসিডিলের পুরোনো বোতলেই নতুন পানীয় ব্যবহার করা হচ্ছে। সম্প্রতি বেশ কয়েক বোতল নতুন নেশাজাতীয় ভারতীয় বোতলসহ আসামিকে আটক করা হয়েছে।
দিওড় ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক মণ্ডল বলেন, তার ইউনিয়নের বেপারিটোলাসহ বেশ কিছু বাড়িতে অবাধে মাদক ব্যবসা চলছে। ৮নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আকরামুল হক, ৯নং ওয়ার্ডের আমিনুল হক এদের বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরে একাধিক মামলা রয়েছে, চেয়ারম্যান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা ডা. নাইম হাসান বলেন, নেশা এমনিতে ক্ষতিকর। এই ভেজাল নেশা আরো ক্ষতিকর। এই নেশা সেবন করলে মস্তিষ্ক বিগড়ে যাওয়াসহ মানুষের কর্ম ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।
বিরামপুর আদর্শ মাদক নিরাময় কেন্দ্রের পরিচালক এ এইচ এম মনজিরুল আলম (সোহাগ) বলেন, আমিও ২০১৪ সালের দিকে মাদক আসক্ত হই। আমি জয়পুরহাট উদরাময় মাদকাসক্ত কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হই। তারপর আমি বিরামপুরে ২০১৬ সালে আদর্শ মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র খুলি। এটি রেজিস্ট্রেশন পায় ২০১৯ সালে। ৫ বছরে আমি ১ হাজার রোগীকে ৩ মাসের কোর্সে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছি। আমার এখানে মাদকসক্তরা চিকিৎসা নিয়ে পুরোপুরি ভালো হচ্ছে।
মন্তব্য করুন