‘ঈদে যদি না হয় শাড়ি ,অপূর্ণ রয়ে যায় নারী’। কথায় বলে শাড়িতেই নারীকে মানায় ভালো। আর তা যদি হয় জামদানি, তাহলে তো কথাই নেই। জামদানি শাড়ি প্রায় প্রতিটি নারীরই কাঙ্ক্ষিত পণ্য। তাই আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের জামদানি পল্লীগুলোতে জামদানি কারিগর ও শিল্পীরা শাড়ি তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। কেউ কাপড়ে সুতা তুলছেন, কেউ সুতা রঙ করছেন, কেউ শাড়ি বুনছেন, আবার কেউ শাড়িতে নকশার কাজ করছেন। রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকার ক্রেতারাও ভিড় জমাচ্ছে পল্লী এলাকাগুলোতে। ক্রেতা ও বিক্রেতাদের হাঁকডাকে এবার কারখানার মালিক ও কারিগরদের চোখেমুখে যেন হাসি উঁকিঝুঁকি মারছে।
উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে প্রায় আড়াই হাজার জামদানি তাঁত রয়েছে। এর মধ্যে আলমদীচরভুলা, মালিপাড়া, সাদিপুর,ব্রাহ্মণবাওগাঁ, খেজুরতলা, কাজিপাড়া, চৌরাপাড়া, মুছারচর, শেকেরহাট, বাসাবো, তিলাব, বস্তল, কলতাপাড়া, কাহেনা, গনকবাড়ি, ওটমা, রাউৎগাঁও, নয়াপুর, উত্তর কাজিপাড়া, চেঙ্গাইন, খালপাড় চেঙ্গাইন, ভারগাঁও, কান্ধাপাড়া, ফিরিপাড়া, বাইশটেকি, আদমপুর, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন এলাকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তাঁত রয়েছে।
ঈদ সামনে রেখে এসব গ্রামের তাঁতি পরিবারগুলো এতটাই ব্যস্ত সময় পার করছে যেন একটু ফিরে তাকানোর সময় নেই তাদের। তাঁতগুলোতে নারীও পুরুষরা সমানতালে কাজ করছেন।
সরেজমিনে সোনারগাঁয়ের বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের জামদানিপল্লী ও উপজেলার বিভিন্ন জামদানিপল্লীর মালিক ও কারিগরদের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা যায়, এ বছর রমজানের প্রথম থেকেই গত ৪-৫ বছরের তুলনায় জামদানি দ্বিগুণ বিক্রি হয়েছে। তারা জানান, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ক্রেতারা এসে অগ্রিম মূল্য দিয়ে নিজেদের পছন্দের শাড়ির কথা জানিয়ে যান। এরপর তাদের চাহিদা অনুযায়ী জামদানি শাড়ি তৈরি করেন।
বহির্বিশ্বে জামদানি শাড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে উল্লেখ করে তারা বলেন, ‘আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ভারত ও নেপালসহ অনেক দেশে এই শাড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সেসব দেশে আমাদের শাড়ি বিক্রি হচ্ছে। প্রকারভেদে ৩ হাজার থেকে শুরু করে ১ লাখ টাকা দামের শাড়ি রয়েছে। এ ছাড়া থ্রি-পিস এক হাজার ২০০ টাকা থেকে শুরু করে তিন হাজার টাকা এবং পাঞ্জাবি এক হাজার টাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দামের রয়েছে।’
শাড়ি তৈরির কারিগরদের মজুরি প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীরা জানান, ‘উৎপাদনের ভিত্তিতে শাড়ির প্রকারভেদ অনুযায়ী কারিগরদের মজুরি দিতে হয়। যেমন, ১০ হাজার টাকা দামের একটি শাড়ি তৈরি করতে দুজন কারিগর কাজ করে থাকে। তাদের মজুরি বাবদ ৯ হাজার টাকা দিতে হয়।
মিহি জমিনে সূক্ষ্ম নকশাদার কাজ দিয়ে তৈরি ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ির চাহিদা শুধু দেশে নয়, বিদেশেও। তবে তাঁতশিল্পীরা বর্তমানে জামদানি শাড়ির পাশাপাশি সালোয়ার কামিজসহ ছেলেদের জন্য পাঞ্জাবিও তৈরি করছেন। এ ছাড়াও শাড়ি তৈরিতে নকশার প্রকারভেদে এক সপ্তাহ থেকে এক মাস পর্যন্ত সময় লাগে।
উপজেলার জামপুর ইউনিয়নের মালিপাড়া গ্রামের জামদানি শাড়ি কারখানার মালিক শুক্কুর আলী জানান, কটন ও রেশমি সুতা দিয়ে পুরোপুরি হাতে তৈরি হয় জামদানি শাড়ির কাপড়। এ জন্য অন্য কাপড়ের তুলনায় জামদানি কাপড়ের দাম একটু বেশি হয়ে থাকে। বৈশাখী উৎসব, দুই ঈদ ও পূজার মৌসুমে সবচেয়ে বেশি কাজ থাকে। এবারও প্রচুর কাজ পেয়েছি। ধারণা করছি, আশানুরূপ বিক্রি করতে পারব।
সোনারগাঁয়ের বাইশটেকী গ্রামের জামদানি পল্লীতে ঢাকা থেকে আসা আকলিমা আক্তারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, ব্যবসায়িক প্রয়োজনে তিনি প্রায়শই সোনারগাঁয়ের জামদানি পল্লীগুলোতে আসেন। ঢাকাতে তার একটি দোকান আছে।ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রতি বছরের ন্যায় এবারও তিনি পাইকারি দরে জামদানি শাড়ি, সালোয়ার কামিজ ও পাঞ্জাবি ক্রয় করতে এসেছেন।
তিনি জানান, করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে গত ৩/৪ বছর ক্ষতির সম্মুখীন হলেও এবার তা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় আছেন। এবার জামদানির প্রতি ক্রেতাদের প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
সোনারগাঁ জামদানি তাঁতি প্রাথমিক সমিতির সভাপতি মো. সালাউদ্দিন বলেন, ‘করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে এ বছর আমাদের ব্যবসা কয়েকগুণ বেড়েছে। আসন্ন ঈদকে কেন্দ্র করে কারিগররা ব্যস্ত সময় পার করছেন। ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায়, নানা রঙবেরঙের শাড়ি দোকানে তুলেছেন। এই ঈদে আশা করি প্রায় ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকার বেচাকেনা হবে সোনারগাঁ জামদানি পল্লিতে।
বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন জাদুঘরের উপপরিচালক একে আজাদ জানান, প্রতি বছরই ফাউন্ডেশনের ভেতরে মাসব্যাপী লোক ও কারুশিল্প মেলায় জামদানি শাড়ি ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য বিশেষভাবে দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন জাদুঘরের ভেতরে জামদানি পল্লী রয়েছে যেখানে সারা বছরই জামদানি শাড়ি,সালোয়ার কামিজ,ফতুয়া ও পাঞ্জাবি পাওয়া যায়। সোনারগাঁয়ের ঐতিহ্য ও গৌরব ধরে রেখেছেন জামদানি শিল্পীরা।
সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুল্লাহ আল মাহফুজ জানান, জামদানি পল্লীগুলো সোনারগাঁয়ের একটি ঐতিহ্য ও অস্তিত্ব। আমরা এ পেশায় জড়িতদের সহজ শর্তে ঋণ ও সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতাসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করি।
মন্তব্য করুন