পায়ে বুট, হাতে অস্ত্র, গায়ে পোশাক পরে বান্দরবানের থানচির সোনালী ও কৃষি ব্যাংক ডাকাতি করতে এসেছিল অস্ত্রধারীরা। সামরিক বাহিনীর কায়দায় যেমন ছিল পোশাক তেমনি কমান্ডোদের মতো ছিল মুখে দাগ মাখানো। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
ফুটেজে দেখা যায়, দিন দুপুরে থানচি থানায় নির্দিষ্ট পোশাক পরে সিঁড়ি দিয়ে সোনালী ব্যাংকে প্রবেশ করছে অস্ত্রধারীরা। তাদের প্রবেশ করতে দেখে ব্যাংকে থাকা গ্রাহকরা দিগ্বিদিক ছুটছেন। অনেকেই মূল দরজা দিয়ে দৌড়ে নামার চেষ্টা করেন।
ফুটেজে আরও দেখা যায়, অস্ত্রধারীরা ব্যাংক কর্মকর্তা ও গ্রাহকদের অস্ত্র তাক করছেন। ভয়ে অনেকে দুই হাত তুলে নিজেকে সমপর্ণ করছেন। এর মধ্যে সহযোদ্ধাদের কেউ কেউ ব্যাংকের প্রাঙ্গণে পাহাড়া দিচ্ছেন। অস্ত্রধারীদের অনেকে ব্যাংকের ক্যাশের ড্রয়ায়ের খোঁজাখুঁজি করছেন। পরে সেখানে থাকা টাকা লুট করে নিয়ে যায়। থানচি থানার ২০০ গজের মধ্যে সোনালী ব্যাংকে এ ঘটনা ঘটে।
সিসিটিভির আরেকটি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, গত ২ এপ্রিল রাতে রুমার সোনালী ব্যাংকের ভল্ট ভাঙার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অস্ত্রধারীরা। তবে বহুবার চেষ্টা করেও ভল্ট ভাঙতে না পেরে অস্থিরভাবে পায়চারী করেছিলেন অনেকে।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নুরে আলম মিনা জানান, নারী সদস্যরা সোনালী এবং কৃষি ব্যাংকে ঢুকে তারা মুহূর্তের মধ্যে ক্যাশে যে নগদ টাকা ছিল সেগুলো নিয়ে দৌড়ে এসে গাড়িতে ওঠে। এ ঘটনায় তিনটি গাড়ি ব্যবহার করে। ব্যাংকের বাইরে তাদের অস্ত্রসহ সহযোদ্ধারা ছিল। আসামিদের গ্রেপ্তারের পর আমরা জিজ্ঞাসা করব তারা কার কার নেতৃত্বে এ ঘটনা ঘটল এবং এতে কারা অংশ নিয়েছে।
এদিকে সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সদস্যদের অস্ত্র ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আহ্বান জানিয়েছিল বান্দরবানের শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি। তবে এখন পর্যন্ত সংগঠনটির পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
শান্তি কমিটির সভাপতি বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা ও সদস্য সচিব লালজারলম বম স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলেছেন, আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি তথা আপামর জনগণ এই উদ্ভট পরিস্থিতি কোনোভাবে কামনা করি না। এমন অশান্ত পরিস্থিতি পরিহার এবং সম্পাদিত সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী কেএনএফের সব সদস্যকে শান্তি বজায় রেখে এবং অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।
শান্তি কমিটির আহ্বানে কেএনএফের সদস্যরা কোনো সাড়া দিয়েছিল কিনা এমন প্রশ্নে বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি লালজারলম বম বলেন, আমরা কেএনএফের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। তবে এখনও পর্যন্ত তাদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পায়নি।
শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সদস্যরা জানান, কেএনএফের বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর অভিযানের মধ্যে ২০২৩ সালের ৩০ মে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠিত হয়। সংঘাত বন্ধে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে কেএনএফের শান্তি আলোচনা শুরু হয় গত বছরের ১৯ জুলাই। জুলাই ও আগস্টে কমিটির সঙ্গে কেএনএফের কয়েকবার ভার্চুয়াল আলোচনাও হয়। তাতে সংগঠনটি সাত দফা দাবিনামা তুলে ধরে। প্রতিশ্রুতি দেয় আপাতত সন্ত্রাসে না জড়ানোর। গত বছরের নভেম্বর এবং চলতি বছরের মার্চে কেএনএফের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সরাসরি দুটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ২ ও ৩ এপ্রিল রুমা ও থানচিতে সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে ডাকাতি, ব্যাংক ব্যবস্থাপক অপহরণ, টাকা লুট ও পুলিশ-আনসারের ১৪টি অস্ত্র ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। নতুন সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ এসব সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে। এদিকে ব্যাংক ডাকাতি এবং খোয়া যাওয়া অস্ত্র উদ্ধারে কয়েকদিন আগে থেকে যৌথ বাহিনী অভিযান শুরু করেছে। অভিযানে অংশ নিচ্ছেন সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। অভিযান সমন্বয় করছে সেনাবাহিনী।
বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক লালথেন বম বলেন, কেএনএফের এ রকম সিদ্ধান্তের কারণে সবার মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পাড়াগুলোতে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে।
প্রসঙ্গত, কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামে এই সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করে ২০২২ সালের এপ্রিলে। সংগঠনটির প্রধান নাথান বম। তাদের মূল দাবি, পার্বত্যাঞ্চলের ৯টি উপজেলাকে নিয়ে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গড়া। সংগঠনটি আত্মপ্রকাশের পর এই প্রথম এত বড় হামলা চালাল।
মন্তব্য করুন