বাবা বিদেশে, মা ও ছোট বোনটাও চলে গেল না ফেরার দেশে। এটা যেন দুই বোন কিছুতেই মানতে পারছে না। মঙ্গলবারের দুর্ঘটনার আগেও সকালে তারা মায়ের হাতে খাবার খেয়েছে। দুর্ঘটনায় মা ও ছোট বোনকে হারিয়ে পাগলপ্রায় অবস্থা মিনা-মিলি দুই বোনের।
মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) সকালে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ফরিদপুর সদরের কানাইপুর দিপনগর এলাকায় এ্যাবলুম ক্যাফেটেরিয়ার সামনে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৫ জনের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন মিলি-মিনার, মা সোনিয়া বেগম (৩২) ও ছোট বোন নুরানি আক্তার (১)। তারা আলফাডাঙ্গার সদর ইউনিয়নের বেজিডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা এবং একই গ্রামের সৌদি প্রবাসী মিল্টন শেখের স্ত্রী ও কন্যা।
বুধবার (১৭ এপ্রিল) বিকেলে বেজিডাঙ্গায় মিনা-মিলির বাড়িতে গেলে দেখা যায় দুই বোন মন খারাপ করে বসে আছে। আর রাস্তার অপর পাশেই বাশ বাগানে কবরে শায়িত তাদের মা সোনায়া এবং ছোট বোন নূরানী।
মিনা মায়ের কবরের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আর কাঁদে। স্বজনরা তাদের দু বোনকে ঘিরে বসে আছে। তারা দু বোনের কান্না দেখে তারাও কাঁদে। একই গ্রামে খানিকটা দূরেই অন্য পাড়াতে গতকালের দুর্ঘটনায় জাহানারা বেগম নামেও একজন নিহত হয়েছেন। ছোট গ্রামের সমস্তটুকু যেন শোকে স্তব্দ।
সোনিয়ার বড় মেয়ে মিলি বেজিডাঙ্গা কাজী আমেনা ওয়াহেদ উচ্চ বিদ্যালয়েরে নবম শ্রেণির ছাত্রী। আর ছোট মেয়ে মিনা স্থানীয় বেজিডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে।
মিলি কালবেলাকে বলে, আমরা তিন বোন মায়ের সাথে ঘুমাতাম। প্রতিদিন সকালে আমাদেরকে মা ঘুম থেকে ডেকে উঠাতেন। সকালের নাশতা খাইয়ে স্কুলে পাঠাত আমাদের দুই বোনকে। গতকালও মা সকালে ফরিদপুর যাবার আগে আমাদের ঘুম থেকে উঠিয়ে ছোট বোন মিনাকে মকতবে পাঠিয়ে আমাকে হাস মুরগির খোপ খুলে খাবার দিতে বলেন, কিন্তু আজ আর আমার মা নেই, আমাদের দেখাশোনা করার কেউ নেই।
মিনা কিছুই বলতে পারছে না সে শুধুই কাঁদছে অঝরে। মিলি-মিনার বাবা মিল্টন শেখ জীবিকার তাগিদে এক বছর আগে অবৈধভাবে সৌদি আরবে পাড়ি দেন।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, মিল্টন অবৈধ পথে সৌদি আরব যাওয়ায় এখনই ফিরতে পারবেন না। কবে ফিরতে পারবেন, তাও জানা নেই। তবে স্ত্রী ও ছোট মেয়ের মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়েছে তাঁকে। বাবা বিদেশে, মা না-ফেরার দেশে চলে যাওয়ায় তারা কীভাবে বাঁচবে, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় সবাই।
মিনা-মিলির দাদা পঙ্গু, দাদির কাছে তারা থাকে। তার বাবা মিল্টন প্রবাসে থাকলেও কাগজ না থাকায় পালিয়ে যা চাকরি করে যা উপার্জন করে তা দিয়ে নিজেই কোনো রকম চলে বাড়ি টাকা পাঠাতে পারে না। মিনা-মিলি ও তার মা সোনিয়া এবং ছোট বোন নূরানী ও দাদা পঙ্গু আজিজার শেখকে নিয়ে তার দাদির সংসারে একসাথে থাকত। দাদি হাসি বেগম এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ করে যা পেত তাই দিয়েই তাদের সংসার চলে।
দাদি হাসি বেগম কালবেলাকে বলেন, আমার দুই ছেলে তৈয়ব এবং মিল্টন। ছোট ছেলে মিল্টন বিদেশে পালিয়ে কাজ করে তা দিয়ে তার নিজের চলা কষ্ট। আমাদের জায়গা নাই থাকার যে জায়গায় থাকি সেটাও পরের জায়গা। আমি বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করে কষ্ট করে সংসার চালাই। এই ছোট ছেলের বউ সোনিয়া আমাকে সহযোগিতা করত। সেও আমাকে ছেড়ে চলে গেল। অনেক ভালো মানুষ ছিল সোনিয়া। আমাদের অভাব থাকলেও সুখ ছিল। আমাদের সংসারে সোনিয়া খুব কষ্ট করত, কালকে তার মামাবাড়ির আত্মীয়র মাধ্যমে সরকারি ত্রাণের টিন আনতে ফরিদপুর যাবার পথে দুর্ঘটনায় মারা যায় ছোট নাতনিসহ। আরও দুই নাতনি ওরা এতিম হয়ে গেল।
এদিকে মিলটন ভিডিও কলে প্রতিবেদককে কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, আমি বড্ড অসহায় হয়ে গেলাম, আমি কি করব! আমার দুধের বাচ্চা ও বউ চলে গেল। আমার দুই মেয়ে কি করবে কীভাবে থাকবে মা ছাড়া। আমি তো নিরুপায়। আমার কাগজ নাই যে আমার মেয়েদের কাছে চলে আসব।
মন্তব্য করুন