রাজধানীতে ভয়ঙ্কর এক চক্রের সন্ধান মিলেছে। তারা একজনের তথ্য দিয়ে অন্যজনের নামে সিম কেনে এবং নগদ, বিকাশ অ্যাকাউন্ট খোলে। পরে সেই নাম্বার থেকে জিনের বাদশা, পুলিশের এসপি, বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা, বিকাশ-নগদ কর্মকর্তা সেজে প্রতারণা করে। এই চক্রের ৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তাররা হলেন- অনিক (২২), মো. রবিউল হোসেন (২৫), সাব্বির করিম আহাম্মেদ (৩৭), জোবায়ের আলম (৩৬), মোক্তার হোসেন (২৫), অন্তু দে (২২), ফজলুল করিম নাহিদ (৩৪)। তাদের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মিরপুর মডেল থানার একটি মামলা তদন্তে বেরিয়ে আসে ভয়ঙ্কর এই চক্রের নাম।
গ্রেপ্তারদের কাছ থেকে বিভিন্ন মোবাইল অপারেটর কোম্পানির ২১৪টি সিম, একটি ল্যাপটপ, স্মার্ট ফোন ৮টি, ট্যাব ২টি, বাটন ফোন ৫টি, ‘নগদ পকেট ডাক্তার’ সংবলিত ডিসকাউন্ট কার্ড ৫০০টি, ‘গ্রিন বাংলা আরকেআর’ লেখা সংবলিত কার্ড হ্যাঙ্গার, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, স্যালারি শিট ও টি শার্ট, বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তার সিল, ভুয়া পুলিশ কার্ড, ভুয়া সাংবাদিক কার্ড, নগদ ডাকবিভাগের ডিজিটাল লেনদেনের কার্ড, বিভিন্ন ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
৩ ধাপে ভয়ঙ্কর প্রতারণা
মূলত এই প্রতারক চক্র তিন ধাপে প্রতারণার কাজ করে থাকে। প্রতিটি ধাপেই আলাদা আলাদা গ্রুপ কাজ করে। প্রথম ধাপে প্রথম গ্রুপ বিভিন্ন মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্র, আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করে। এই গ্রুপ তাদের এসব তথ্য দ্বিতীয় গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেয়।
দ্বিতীয় ধাপে এই গ্রুপ এসব তথ্য দিয়ে এসব নামে সিম কেনে এবং বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্ট খুলে। এরপর এসব সিম তারা উচ্চ মূল্যে বিক্রি করে দেয় তৃতীয় গ্রুপের কাছে। তারা এসব সিম ব্যবহার করে কখনো জিনের বাদশাহ, কখনো বিকাশ বা নগদ এজেন্ট, আর কখনোবা বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা সেজে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে।
অরুণার মোবাইলই নেই, কিন্তু সিম আছে, বিকাশ-নগদ আছে!
বিকাশের মাধ্যমে প্রতারণার অভিযোগে ২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মিরপুর মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। সেই মামলা তদন্তে গিয়ে আটক করা হয় অরুণাকে। কিন্তু অরুণা জানান, তার কোনো মোবাইলই নেই, তিনি কোনো মোবাইলই ব্যবহার করেন না! তাই তার কাছে কোনো সিম নেই। কোনো বিকাশ কিংবা নগদ অ্যাকাউন্টও নেই।
পরে প্রযুক্তির সহায়তায় নিশ্চিত হওয়া যায়, এই ঘটনার সঙ্গে অরুণার যোগসাজশ নেই। কারণ, অরুণা ঢাকায় থাকলেও সেই সিমের অবস্থান রাজশাহীতে! পরে অরুণাকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, সরকার স্বল্পমূল্যে চাল, ডাল, তেল দিবে বলে কিছুদিন আগে তাদের বাসায় কয়েকজন লোক আসে। তারা এজন্য তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র, আইরিস (চোখের ছাপ) ও আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে যায়। কিন্তু এরপর তারা আর আসেননি।
মূলত স্বল্পমূল্যে চাল, তেল দেওয়ার নাম করে তাদের তথ্য হাতিয়ে নিয়েছিল অনিকের গ্রুপ। তাদের যাতে মানুষ সন্দেহ না করে এজন্য তারা মাঝে মাঝে বিভিন্ন বাসায় আটার প্যাকেট, তেলের বোতলও সঙ্গে নিয়ে যেত! সবাই প্রতিষ্ঠানের লোগো সম্বলিত একই ধরনের টি-শার্টও পরত।
প্রতারক চক্রে মোবাইল ব্যাংকিং কর্মকর্তাও!
ভয়ঙ্কর এই প্রতারক চক্রের দুই সদস্য চাকরি করেন মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বিকাশেও। গ্রেপ্তার জোবায়ের ও সাব্বির বিকাশের ডিএসএস (ডিস্ট্রিবিউটর সেলস সুপারভাইজার) এবং মোক্তার হোসেন ও অন্তু দে ডিএসও (ডিস্ট্রিবিউটর সেলস অফিসার)। তারা তাদের কাছে থাকা পাসওয়ার্ড এজেন্টের কাছে দিয়ে দেন। ফলে এজেন্ট সহজেই অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলতে পারে। তাদের দাবি, প্রতিষ্ঠানের বেঁধে দেওয়া মাসিক টার্গেট পূরণের জন্যই তারা এভাবে এই প্রতারক চক্রকে ‘সহযোগিতা’ করেছেন।
৫০ টাকার সিম ৫ হাজার টাকা!
সাধারণত একটি সিমের দাম ৫০ টাকা। ক্ষেত্র বিশেষে কিছু সিম ১০০ টাকায়ও বিক্রি হয়। কিন্তু এ প্রতারক চক্রের সিমের দাম ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। তারা যেসব সিম প্রতারণার মাধ্যমে সংগ্রহ করে তা বিক্রি করে অন্য প্রতারক চক্রের কাছে। যেহেতু এসব প্রতারক চক্র জিনের বাদশাহ, বিকাশ, নগদ প্রতারণাসহ অন্যান্য প্রতারণার কাজে এসব সিম ব্যবহার করে তাই তাদের কাছে এসব সিমের খুব চাহিদা। এসব সিম তারা এক হাজার থেকে শুরু করে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত দিয়ে কিনে।
তারা কখনো জ্বিনের বাদশাহ, কখনো পুলিশের এসপি!
প্রতারণার মাধ্যমে সংগৃহীত এসব সিম দিয়ে অনিকরা বিভিন্ন মানুষকে ফোন করে টাকা হাতিয়ে নেয়। তারা কখনো জিনের বাদশাহ সেজে ফোন দেয়। কখনো পুলিশের এসপি সেজে মামলা থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নেয়। আবার কখনো বিকাশ কিংবা নগদের কর্মকর্তা সেজে প্রতারণা করে।
মন্তব্য করুন