বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. মাকসুদুর রহমানের পদত্যাগের পর নতুন প্রক্টর হিসেবে শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমদকে গত ২৮ আগস্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগের পরের দিন তিনি তার কার্যালয়ে যোগদান করেন। ইতোমধ্যে তিনি শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়ার আলোকে ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য কাজ শুরু করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিসেবে তার অনুভূতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ সামগ্রিক বিষয়ে সম্প্রতি কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন কালবেলার ঢাবি প্রতিনিধি মো. জাফর আলী।
কালবেলা: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে আপনার ওপর প্রক্টরের দায়িত্ব অর্পিত হওয়ার অনুভূতি কেমন?
সাইফুদ্দীন আহমদ: পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারকে নিয়ে কাজ করার গুরুদায়িত্ব আমার ওপর অর্পিত হয়েছে। এটা আমার জন্য বেশ কঠিন কাজ। তবে আমি মনে করছি, এটা একটা সুযোগও বটে। কারণ, শিক্ষার্থীরা যে ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় চাচ্ছে তাদের সেই চাওয়ার সঙ্গে আমার দৃষ্টিভঙ্গিরও কিছুটা মিল রয়েছে। আমি আশা করছি, বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি শিক্ষার্থী ও পড়ালেখাবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে যথাসম্ভব কাজ করব। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্থলে কোনোরকম ভয়ভীতি ছাড়াই আনন্দের সঙ্গে একাডেমিক ও অন্যান্য কাজ করবে, তাদের এমন আকাঙ্ক্ষাকে বিবেচনা করে সহযোগিতা করতে পারব বলে আমি আশাবাদী। যদিও এক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
কালবেলা: বৈষম্যমুক্ত মূল্যবোধকে ধারণ করে এই মুহূর্তে আপনার কতটুকু স্বাধীনভাবে কাজ করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন?
সাইফুদ্দীন আহমদ: বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের ওপর সারা দেশের মানুষের যে আস্থা তৈরি হয়েছে, সেই আস্থা-বিশ্বাসই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আমাকে অনুপ্রেরণা জোগাবে এবং এই শিক্ষার্থীরাই আমার কাজে বড় সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
কালবেলা: আপনার দায়িত্বের জায়গা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে কি কি বিশেষ চিন্তা বা আকাঙ্ক্ষা আছে?
সাইফুদ্দীন আহমদ: আমি মূলত অন্তর্ভুক্তিকরণ তত্ত্বে বিশ্বাস করি। দল-মত, ধর্ম-বর্ণ ও শ্রেণি নির্বিশেষে আমার কাছে সব শিক্ষার্থীর পরিচয় হবে যে, 'তারা আমার শিক্ষার্থী'। আমার দীর্ঘ শিক্ষকতার জীবনে শিক্ষার্থীদের আমি যেভাবে বিবেচনা করেছি, প্রক্টর হিসেবেও আমি সেই বিবেচনাই করব। প্রথমত, আমি ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করব। দ্বিতীয়ত, ক্যাম্পাস সার্বিক শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের চেষ্টা করব। এক্ষেত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সুসজ্জিত বিএনসিসি ক্যাডেটদের কীভাবে জোরালোভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে সেটা নিয়ে কাজ করব। এ প্রেক্ষিতে তাদের জন্য কিছু আর্থিক প্রণোদনাও থাকবে, পাশাপাশি তাদের জীবনে বিভিন্ন অভিজ্ঞতাও অর্জন হবে।
কালবেলা: ক্যাম্পাসে বহিরাগত, মাদক ও যানবাহন নিয়ন্ত্রণে আপনার কীভাবে কাজ করার ইচ্ছে আছে?
সাইফুদ্দীন আহমদ: যানবাহন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে একটা বিষয় মাথায় রাখা উচিত যে, সেটা হলো ক্যাম্পাসের রাস্তাগুলো সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে আবার ট্রাফিক হচ্ছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তত্ত্বাবধানে। আমরা তাদের সঙ্গে বসে আলোচনা করব যে, কীভাবে তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে আমাদের ক্যাম্পাসে বহিরাগত ও যানবাহন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, কীভাবে আমাদের ক্যাডেটরা কাজ করতে পারে। হলগুলোর সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে হল কর্তৃপক্ষ কাজ করবে, এ ব্যাপারে শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আমরা সর্বোচ্চ সহায়তার চেষ্টা করব। হলগুলোতে খাবারের দাম ও মান যৌক্তিক পর্যায়ে আনতে কাজ করব। ক্যাম্পাসে অনেক ভাসমান দোকান রয়েছে, সেগুলো রুলস রেগুলেশনের আওতায় আসবে। আমরা এসব সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসে আলাপালোচনা করে নেব। ক্যাম্পাসে মাদকের ব্যাপারে আমার জিরো টলারেন্স নীতি থাকবে, তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই শিক্ষার্থীদের সহায়তা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের সহায়তা ছাড়া আমরা এগোতে পারব না।
কালবেলা: বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মোড়ে স্থাপিত সিকিউরিটি সার্ভিলেন্স বক্সগুলোকে চালু ও সক্রিয় করার ব্যাপারে কী ভাবছেন?
সাইফুদ্দীন আহমদ: আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সিকিউরিটি অফিস আছে এবং অফিসার রয়েছেন। সে সিকিউরিটি অফিসারের নেতৃত্বে ক্যাম্পাসে কিছু টিম কাজ করে। আমি তাদের সঙ্গে বসব এবং জানার চেষ্টা করব যে, তাদের ম্যান্ডেড কি, তাদের জনবল কেমন, তারা কীভাবে কাজ করে, কেন সিকিউরিটি সার্ভিলেন্স বক্সে লোক নেই, সেই বিষয়গুলো আমি খোঁজখবর নিয়ে তাদেরকে কীভাবে অ্যাকটিভেট করা যায় সেটা বিবেচনা করে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ক্যাম্পাসের নিরাপত্তায় পেশাদার নিরাপত্তা কর্মীদের সহায়তাও যদি নেওয়ার প্রয়োজন হয় সে ক্ষেত্রেও বিবেচনা করা হবে।
কালবেলা: ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা রিকশা বা অটোরিকশা চালু করে ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়ার চিন্তা আপনার আছে কি না?
সাইফুদ্দীন আহমদ: অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে আমরা দেখি, ভেতরে যারা রিকশা চালায় তাদের আলাদা ইউনিফর্ম থাকে, তখন শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দেখেই বুঝতে পারে যে, সেই রিকশা ওই ক্যাম্পাসেরই। সে রকম আমাদের ক্যাম্পাসেও কিছু রেজিস্ট্রার্ড রিকশা রাখা যায় কি না সেটা ভাবছি। রেজিস্ট্রার্ড রিকশাচালকদের সঙ্গে আমরা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বসে ভাড়া নির্ধারণ করব, যাতে করে কেউ হয়রানির শিকার না হয়।
কালবেলা: বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হওয়া বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মতো ঘটনায় তদন্ত অর্থাৎ বিচারিক কাজগুলোতে প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিতে কীভাবে কাজ করবেন? বিশেষ করে, অপরাধ না করে শাস্তি পাওয়া, অপরাধ করে বেঁচে যাওয়া অথবা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে চরিতার্থ করা ইত্যাদি বিষয়ে আপনার চিন্তাভাবনা কী?
সাইফুদ্দীন আহমদ: বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কালচার অনেকাংশে আমাদের শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ঠেলে দিতে বাধ্য করেছে। দীর্ঘদিন ধরে এই কালচারের কারণে আমাদের অনেক শিক্ষকও নির্যাতিত হয়েছেন এবং অনেক শিক্ষার্থীও। আমার জন্য যেটা সুবিধা সেটি হচ্ছে, আমি এই মুহূর্তে কোনো রাজনৈতিক সরকারের অধীনে কাজ করছি না, আমার ওপরে কোনো রাজনৈতিক চাপ নেই। আমার ওপরে একটাই চাপ আছে যে, আমি কতটা ন্যায়বিচার করতে পারব। প্রক্টর হিসেবে আমার জায়গা থেকে কোনো বৈষম্য হবে না সেই নিশ্চয়তা আমি দিতে পারি। আমার কাছে বৈষম্যের ঠাঁই নেই। এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি, আমার পাশে শিক্ষার্থীদের 'ভ্যানগার্ড' হিসেবে থাকতে হবে, সবকিছুতে তাদের সতর্ক থাকতে হবে এবং নজর রাখতে হবে। কয়েকদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজে একটি ঘটনায় এক শিক্ষার্থীকে পর্যবেক্ষক হিসেবে রেখেছি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্য মহোদয়দের অনুরোধ করব যে, কোনো ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হলে অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত দুই পক্ষেরই প্রতিনিধি রাখা চিন্তা যেন করা হয়। এতে তদন্তে স্বচ্চতা থাকবে বলে মনে হয়। আর আমার জুরিসডিকশনে এ রকম কোনো ঘটনা আসলে আমি এই ফর্মুলা অনুসরণ করার চেষ্টা করব।
কালবেলা: বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
সাইফুদ্দীন আহমদ: একটা ম্যাসাকারের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে, অনেক জায়গাতেই প্রশাসন নেই, কিন্তু শিক্ষার্থীরা অনেক জায়গায় অনেককিছু সুশৃঙ্খলভাবে সামাল দিয়েছে। আমার প্রত্যাশা থাকবে, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেন এই ধারাটা অব্যাহত রাখে। কারো বিরুদ্ধে যদি তাদের ক্ষোভ এবং অভিযোগ থাকে সেক্ষেত্রে তারা একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করবে বলে আশা করি, তাতে আমাদের জন্য যে কোনো কিছু সহজ হবে। শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও যেন পদ্ধতি অনুসরণ করেন, তাহলেই যেকোনো ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাটা আমাদের জন্য সহজ হবে।
কালবেলা: আপনাকে ধন্যবাদ।
সাইফুদ্দীন আহমদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন