মাছ চাষে দেশি প্রোবায়োটিকের কার্যকারিতা বেশি। এতে মাছের বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ হয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষকের গবেষণায় এটি উঠে এসেছে।
প্রোবায়োটিক হচ্ছে উপকারী অণুজীব যাদের উপস্থিতিতে ক্ষতিকর অণুজীব দমন করা যায় এবং এদের ক্ষতি করার ক্ষমতাও কমানো যায়।
প্রোবায়োটিকের পরিমাণ, প্রয়োগ মাত্রা এবং বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণাটি হয়। ‘বাংলাদেশের নির্বাচিত চাষযোগ্য মাছের প্রজাতির বৃদ্ধি ও প্রজননে প্রোবায়োটিকের প্রভাব নিরূপণ’ শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে এ গবেষণা করেন মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শাহজাহান ও তার দল।
তিন বছরের ওই প্রকল্পে অর্থায়ন করে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন। ইতিমধ্যে গবেষণাপত্রটি আন্তর্জাতিক ১০টি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া প্রকল্পটি শেষ হবে এ বছরের ডিসেম্বরে। এ প্রকল্পের আওতায় দুজন পিএইচডি ছাত্র গবেষণারত রয়েছেন এবং ১২ জন শিক্ষার্থী স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।
গবেষক শাহজাহান জানান, বাংলাদেশ মাছ চাষের দিক থেকে বিশ্বের মধ্যে অন্যতম একটি দেশ। চাষকৃত মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। এটি সম্ভব হয়েছে মাছ চাষে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, সম্প্রসারণ, বৈচিত্র্যকরণ এবং নিবিড়করণের মাধ্যমে।
মাছের খাবার খরচ মোট উৎপাদনের ৭০ ভাগের বেশি হওয়ায় এই শিল্পের লাভ দিন দিন কমে যাচ্ছে। তাই অল্প খরচে অধিক উৎপাদন করার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন মাছ চাষিরা।
এ জন্য মাছ চাষে রাসায়নিক এবং এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার হচ্ছে। ফলে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিকাশ ঘটছে। যা আমাদের জলজ পরিবেশে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। ফলে এক সময় এন্টিবায়োটিকের মাধ্যমে ক্ষতিকর জীবাণু আর দমন করা যায় না। এ ছাড়া এন্টিবায়োটিক প্রয়োগে তাৎক্ষণিক সমাধান হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা মানবদেহে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এ জন্যই রোগ দমনে এন্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে প্রোবায়োটিকের ব্যবহার অধিক যৌক্তিক এবং স্থায়িত্বশীল বলে বিবেচিত হচ্ছে এবং এর ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রোবায়োটিকের মধ্যে রয়েছে ব্যাসিলাস গ্রুপের ব্যাকটেরিয়া, ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়া, নাইট্রিফাইং ব্যাকটেরিয়া, ডিনাইট্রিফাইং ব্যাকটেরিয়ার সমাহার।
জলজ পরিবেশে প্রোবায়োটিক ব্যবহারের ফলে মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, চাষকৃত প্রজাতির অন্ত্রে উপকারী অণুজীব বংশবিস্তার করে। বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান ও ভিটামিন উৎপাদনে সহায়তা করে, ক্ষতিকর জীবাণুর অতিরিক্ত বংশবৃদ্ধি প্রতিরোধে জৈবিক নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়া মাছের রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়, বৃদ্ধি সহায়ক হিসেবে কাজ করে, হজমে সাহায্য করে, প্রজননের সাহায্য করে, পানির গুণগত মান উন্নত করে, প্রোটিনের অন্যতম উৎস হিসেবে কাজ করে।
গবেষক ডা. শাহজাহান আরও বলেন, এই প্রকল্পের অধীনে মাঠ জরিপ এবং ল্যাব গবেষণা দুটি অংশে বিভক্ত ছিল। মাঠ জরিপ করার জন্য অধিক মৎস্য উৎপাদনকারী চারটি জেলা নির্বাচন করা হয়।
জেলাগুলো হলো- ময়মনসিংহ, রাজশাহী, যশোর ও কুমিল্লা। এই জরিপে দেখা গেছে, ৩৬টি কোম্পানির ৮৮টি প্রোবায়োটিক মাছ চাষে ব্যবহার হচ্ছে এবং সবই কমার্শিয়াল (আমদানিকৃত) প্রোবায়োটিক।
এই প্রোবায়োটিক বাজারে সয়েল প্রোবায়োটিক, গাট প্রোবায়োটিক এবং ওয়াটার প্রোবায়োটিক হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। চাষিদের প্রোবায়োটিক সম্পর্কে ধারণা খুবই কম। বেশিরভাগ সময় তারা বিক্রেতার কাছ থেকে এগুলো নিয়ে আসে এবং জেনে না জেনে ব্যবহার করে।
তবে কিছু কিছু শিক্ষিত চাষিরা প্রোবায়োটিক জেনে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ব্যবহার করছে। তাদের ধারণা, প্রোবায়োটিক ব্যবহার করলে উৎপাদন বাড়বে, মৃত্যুর হার কমবে, পানির গুণগত মান উন্নত হবে, পিএইচের মান বাড়বে এবং কাদার গ্যাস দূর হবে।
মাঠ পর্যায়ে প্রাপ্ত ফলের ওপর ভিত্তি করে সর্বোচ্চ ব্যবহৃত দুটি কমার্শিয়াল (আমদানিকৃত) প্রোবায়োটিক এবং একটি স্থানীয়ভাবে তৈরি করা প্রোবায়টিক নিয়ে ল্যাবে গবেষণা করে দেখা গেছে কমার্শিয়াল (আমদানিকৃত) প্রোবায়োটিকের চেয়ে দেশি প্রোবায়োটিকের কার্যকারিতা বেশি এবং মাছের বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ। তাই আমাদের দেশীয় প্রোবায়োটিক তৈরি করার দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে।
গবেষক দলের সদস্য মো. কবির হোসেন জানান, প্রোবায়োটিকগুলোর কার্যকারিতা পরিবেশের ওপর নির্ভর করে। কারণ বেশিরভাগ প্রোবায়োটিকগুলো অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা হয় এবং সেগুলো তাদের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া প্রোবায়োটিক।
তাই নতুন পরিবেশ তাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং এবং স্থানীয় স্ট্রেনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা বেশ কঠিন। তাদের কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাই স্থানীয় পরিবেশে এবং সুস্থ জীবদেহে প্রাপ্ত স্বাভাবিকভাবে উপকার প্রদানকারী প্রোবায়োটিক যে কোনো বিদেশি প্রোবায়োটিক অপেক্ষা শ্রেয়।
কিছু কিছু কৃষক এমনো দাবি করেন যে, প্রোবায়োটিকগুলোতে ভেজালের কারণে প্রোবায়োটিকগুলো সঠিকভাবে কাজ করে না। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নানা প্রকার প্রোবায়োটিক বাজারে বিদ্যমান। দেশি-বিদেশি প্রোবায়োটিক প্রতিনিয়ত নতুন নতুন নামে বাজারে আসছে।
বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রোবায়োটিকের ভেতরে বিভিন্ন ধরনের অণুজীব থাকে। আর একেক অণুজীব একেক রকমের কাজ করে। তাই প্রোবায়োটিক ক্রয় ও প্রয়োগ করার সময় দেখতে হবে তার ভেতরে কোন কোন ধরনের উপকারী অণুজীব আছে। তারা জীবিত অবস্থায় আছে কিনা এবং অন্য কোনো বহিরাগত ক্ষতিকর জীবাণু আছে কিনা। তাই প্রোবায়োটিক নির্বাচন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
মন্তব্য করুন