

রাতে ঘুমোতে গিয়ে অনেকেই মনে মনে ভাবেন, ‘আলোটা নেভাব নাকি জ্বালিয়েই রাখব?’ বিশেষ করে যেসব বাসায় ছোট বাচ্চা, প্রবীণ বা ভয়-উদ্বেগে ভোগা সদস্য থাকে, সেখানে রাতভর ছোট্ট একটা বাতি জ্বলতেই থাকে। অনেকে ভাবেন, এতে ক্ষতি কি! বরং অন্ধকারের ভয়ের চেয়ে একটু আলোই ভালো।
কিন্তু চিকিৎসক ও ঘুম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষয়টি এতটা নিরীহ নয়। শরীরের ভেতরের ঘড়ি থেকে শুরু করে হরমোন, এমনকি মানসিক প্রশান্তি—সবকিছুতেই প্রভাব পড়ে এই ছোট্ট আলোটির। তাই প্রশ্ন উঠছে, ‘আলো জ্বালিয়ে ঘুমানো কি সত্যিই ক্ষতিকর? ক্ষতিকর হলে কোন মাত্রা পর্যন্ত?’
এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিদেশি সংবাদমাধ্যম দ্য স্ট্যান্ডার্ড। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাতের আলোকে খামোখা উপেক্ষা করলে সেটা আপনার হৃদয়ের জন্য ভয়ানক হতে পারে। ৯ বছর ধরে প্রায় ৮৯ হাজার মানুষের ওপর চালানো একটি বড় আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যারা রাতে উজ্জ্বল আলোতে ঘুমিয়েছে, তাদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইলিউর, করনারি আর্টারি ডিজিজসহ বিভিন্ন হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে; এমনকি সবচেয়ে উজ্জ্বল আলোর পরিবেশে ঘুমালে মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের ঝুঁকি ৪৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ার আশঙ্কা পাওয়া গেছে।
এই বিশাল পরিসরের পর্যবেক্ষণ অস্বীকার্যভাবে বলছে, রাতে আলো তথা সার্কাডিয়ান ক্লক-হস্তক্ষেপের ক্ষতিকর প্রভাবগুলো কেবল ঘুমের গুণে ভিড়ে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে তা রক্তনালির স্বাস্থ্য, শর্করার নিয়ন্ত্রণ, রক্তের জমাট বাধার প্রবণতা এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে অপ্রত্যাশিত অস্থিরতা সৃষ্টি করে। আর এই সমস্যাগুলোর প্রত্যেকটিই হৃদরোগের মৌলিক কারণ। অর্থাৎ, নিছক আলোর অসুবিধা নয়, এটি সাইলো-অফেক্ট নয়; বরং শরীরের বায়োলজিক্যাল রিদমের সঙ্গে লড়াই এবং ফল ভয়াবহ হতে পারে।
গবেষণার সারমর্ম কী?
যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার ঘুম বিশেষজ্ঞদের যৌথ গবেষণায় ৮৮,৯০৫ জনকে ৯.৫ বছর ধরে অনুসরণ করে রাতে আলো এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা হয়। অংশগ্রহণকারীরা হাতের কব্জিতে সেন্সর পরে ২৪ ঘণ্টার আলোর মাত্রা রেকর্ড করেছেন। রাতের সময় ধরা হয়েছে রাত ১২টা ৩০ থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত।
ফলাফল যা বেরিয়ে এসেছে
যারা অল্প আলোতে ঘুমিয়েছেন, তারা তুলনামূলক কম ঝুঁকিতে ছিলেন। কিন্তু যাদের শোবার ঘর ছিল মাঝারি, উজ্জ্বল বা সবচেয়ে উজ্জ্বল পরিবেশে, তাদের জন্য চিত্রটি ভয়ংকর।
১. করোনারি আর্টারি ডিজিজ বাড়ার ঝুঁকি
মাঝারি আলো- ১২%
উজ্জ্বল আলো- ২০%
খুব উজ্জ্বল আলো- ৩২%
২. মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন (হার্ট অ্যাটাক) বাড়ার ঝুঁকি
মাঝারি আলো- ২০%
উজ্জ্বল আলো- ২৭%
খুব উজ্জ্বল আলো- ৪৭%
৩. হার্ট ফেইলিউর বাড়ার ঝুঁকি
মাঝারি আলো- ১৫%
উজ্জ্বল আলো- ২১%
খুব উজ্জ্বল আলো- ৫৬%
৪.️অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন বাড়ার ঝুঁকি (সবচেয়ে উজ্জ্বল আলোতে)
ঝুঁকি বৃদ্ধি-৩২%
৫️. স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়ে
উজ্জ্বল পরিবেশে ঘুমালে ২৮% বেশি
সব মিলিয়ে দেখা গেছে, রাতে ঘর যত উজ্জ্বল, হৃদ্রোগের ঝুঁকি তত বেশি। এমনকি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ BMI, কোলেস্টেরল, শিফট-ওয়ার্ক— এসব নিয়েও হিসাব থেকে বাদ দিলেও আলোজনিত ঝুঁকি ঠিকই থাকে।
হার্টের ঝুঁকি বাড়ার কারণ
আলো শরীরের স্বাভাবিক ছন্দ ব্যাহত করে। রাতে উজ্জ্বল আলো একাধিক শারীরবৃত্তীয় সমস্যা তৈরি করে। যেমন গ্লুকোজ প্রসেসিং কমে যাওয়া , টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি, রক্তের জমাট বাঁধার প্রবণতা বাড়া, রাতে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া এবং দীর্ঘমেয়াদে রক্তনালির ক্ষতি ইত্যাদি। আর এই কারণগুলো মিলেই হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
শেষকথা
গবেষণাটি পর্যবেক্ষণভিত্তিক হওয়ায় সরাসরি কারণ নির্ধারণ করা যায়নি, তবে এতে ঝুঁকির চিত্র স্পষ্ট। রাতে আলো জ্বালিয়ে ঘুমানোকে আমরা অনেকেই তুচ্ছ একটি অভ্যাস মনে করি। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা দেখাচ্ছে এই সামান্য বিষয়টিই আমাদের শরীরের স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট করে হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে পারে।
মন্তব্য করুন