

বাংলাদেশি রান্নাঘরে সবচেয়ে সহজলভ্য ফলের তালিকায় কলা প্রথম সারিতেই থাকে। ভাতের পরে, নাস্তায়, সন্ধ্যার স্ন্যাকে— যেখানেই রাখুন, টেবিল ভরসাম্য রাখতে এটি অপরাজেয়। কিন্তু ওজন কমানোর ক্ষেত্রে কলা নিয়ে বিতর্কও কম নয়। কেউ বলেন, এতে চিনি বেশি, তাই ডায়েটের জন্য অনুপযোগী। আবার কেউ মনে করেন, প্রাকৃতিক শক্তির উৎস হিসেবে কলা ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
আসলে, ‘কলা খাওয়া ভালো না খারাপ’— এই প্রশ্নের উত্তরটি কলার পাকাভাবের ওপরই নির্ভর করে। কারণ সবুজ কাঁচা কলা আর হলুদ পাকা কলা শরীরে একেবারেই ভিন্নভাবে কাজ করে। সেই ভিন্নতাই ঠিক করে দেয়, কোন কলা আপনার ওজন কমানোর যাত্রায় ‘বন্ধু’ আর কোনটি ‘ফুয়েল’।
সবুজ বনাম হলুদ কলা
কলা সবুজ থেকে হলুদ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর ভেতরের উপাদানগুলোও পরিবর্তিত হয়। সবুজ কলায় থাকে রেজিস্ট্যান্ট স্টার্চ, যা শরীরে আঁশের মতো কাজ করে, ধীরে হজম হয়, দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখে এবং রক্তে শর্করা দ্রুত বাড়তে দেয় না। ওজন নিয়ন্ত্রণে এই বৈশিষ্ট্যগুলো বেশ সহায়ক।
অন্যদিকে, হলুদ পাকা কলায় থাকে বেশি পরিমাণ প্রাকৃতিক চিনি, গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ ও সুক্রোজ। ফলে এগুলো দ্রুত শক্তি দেয়, হজমে সহজ, কিন্তু রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়াতে পারে। তাই এগুলো ক্যালরি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে বেশি উপযুক্ত তাৎক্ষণিক শক্তি দরকার হয় এমন পরিস্থিতিতে।
সহজ কথায়
কাঁচা কলা : তৃপ্তিদায়ক, আঁশসমৃদ্ধ, ধীরে শক্তি দেয়
পাকা কলা : দ্রুত শক্তি, মিষ্টি স্বাদ, সহজ হজম
ওজন কমানোর ক্ষেত্রে কোনটা খাবেন, এ নির্ভর করে আপনার প্রয়োজন ও সময়ের ওপর।
সবুজ বনাম পাকা কলার তুলনা (প্রতি মাঝারি আকারের কলা)
পুষ্টি → পাকা কলা (হলুদ) → কাঁচা কলা (সবুজ)
ক্যালরি → প্রায় 105 → প্রায় 89
কার্বোহাইড্রেট → প্রায় 27g → প্রায় 22g
চিনি → প্রায় 14g → প্রায় 6g
আঁশ → প্রায় 3g → প্রায় 4g
রেজিস্ট্যান্ট স্টার্চ → কম → বেশি
পটাশিয়াম → প্রায় 422mg → প্রায় 468mg
ভিটামিন C→ প্রায় 10mg → প্রায় 12mg
ভিটামিন B6→ মাঝারি→ বেশি
অর্থাৎ কম ক্যালরি, বেশি রেজিস্ট্যান্ট স্টার্চ এবং দীর্ঘক্ষণ তৃপ্তি দেওয়ায় কাঁচা কলা ওজন কমানোর জন্য বেশি কার্যকর। তবে পাকা কলাও সম্পূর্ণ বাদ দেওয়ার মতো নয়,ঠিক সময়ে খেলে এটি শরীরের পক্ষে উপকারীই।
গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) ও ওজন নিয়ন্ত্রণে কলা
GI দেখায় খাবার রক্তে শর্করা কত দ্রুত বাড়ায়।
কাঁচা কলা : GI ৩০–৫০ → ধীরে শক্তি দেয়, ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
পাকা কলা : GI ৫১–৬০ → দ্রুত শক্তি দেয়, তবে ক্ষুধা দ্রুত ফিরে আসতে পারে
এ কারণেই ওজন কমাতে কাঁচা কলা বেশি উপযোগী। পাকা কলা খাওয়া যায়, তবে তা ব্যায়ামের আগে/পরে খাওয়া শ্রেয়।
ওজন কমাতে পাকা কলার উপকারিতা
সহজ হজম : নরম টেক্সচার ও সরল চিনি স্ন্যাকস হিসেবে আরামদায়ক।
দ্রুত এনার্জি : ব্যায়ামের আগে শক্তি জোগায়, ক্লান্তি কমায়।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট : ডোপামিন ও ক্যাটেচিন প্রদাহ কমাতে সহায়ক।
ন্যাচারাল সুইটনার : বেকিং-এ ব্যবহার করলে চিনি ও ঘি/বাটারের পরিমাণ কমে।
মুড ও ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ: ট্রিপটোফ্যান মুড উন্নত করে, অযথা খাবার ইচ্ছে কমায়।
ওজন কমাতে কাঁচা কলার উপকারিতা
ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ : রেজিস্ট্যান্ট স্টার্চ দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখে।
রক্তে শর্করার ভারসাম্য : আকস্মিক ‘সুগার স্পাইক’ হয় না।
গাট হেলথ : রেজিস্ট্যান্ট স্টার্চ প্রিবায়োটিক হিসেবে কাজ করে।
কম ক্যালরি : দৈনিক ক্যালরি ঘাটতি বজায় রাখতে সহায়ক।
প্রদাহ কমাতে সহায়ক : কিছু গবেষণায় সামগ্রিক বিপাক উপকারের প্রমাণ রয়েছে।
ওজন কমাতে কোন কলা খাবেন?
আপনার লক্ষ্য কোনটি, সেটাই নির্ধারণ করবে পাকা নাকি কাঁচা কলা উপযোগী।
যদি ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ, ক্যালরি কমানো ও ধীরে শক্তি পাওয়া লক্ষ্য হয় → কাঁচা কলা
যদি দ্রুত শক্তি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ব্যায়ামের সাপোর্ট প্রয়োজন হয় → পাকা কলা
পুষ্টিবিদদের পরামর্শ, একটিকে বাদ না দিয়ে দুটোকেই প্রয়োজন অনুযায়ী ডায়েটে রাখলে ওজন নিয়ন্ত্রণে ভালো ফল মেলে।
ওজন কমাতে দিনে কতটি কলা খাওয়া নিরাপদ?
সক্রিয় জীবনধারা : দিনে ২টি পর্যন্ত খাওয়া ঠিক আছে
ওজন কমানোর পথে : দিনে ১টি ছোট কলা, সঙ্গে প্রোটিন/ফাইবার নিলে তৃপ্তি বাড়ে
কিডনি/ডায়াবেটিস : নিয়মিত খাওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন
ভারতীয় পুষ্টিবিদ অঞ্জলি ঠাকুরের মতে, কলা যেন একমাত্র ফল না হয়; বৈচিত্র্যই ডায়েটের মূল।
ওজন নিয়ন্ত্রণে কলা খাওয়ার সেরা সময়
সকাল : পাকা কলা + ওটস/দই → দীর্ঘক্ষণ শক্তি
ব্যায়ামের আগে : পাকা কলা → দ্রুত এনার্জি
ব্যায়ামের পরে : কলা + প্রোটিন → মাংসপেশি রিকভারি
রাত : কাঁচা কলা তুলনামূলক ভারী; প্রয়োজনে পাকা ছোট কলা খাওয়া যেতে পারে
সূত্র : এনডিটিভি
মন্তব্য করুন