চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে দেশের অসংখ্য মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে। অসংক্রামক রোগের উপদ্রপ এখন বিশ্বজুড়ে। তারমধ্যে বাড়ছে না স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বাজেট বরাদ্দ। এতে ব্যয় মেটাতে গিয়ে দেশের মানুষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি ও সেবার পরিধি বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ।
মঙ্গলবার (১১ জুন) কারওয়ানবাজার ডেইলি স্টার ভবনে সিভিল ‘সোসাইটি অর্গানেইজেশন (সিএসও) ফোরাম এবং ডেইলি স্টার যৌথ আয়োজিত পাবলিক হেলথ এক্সপান্ডিচার: এ ক্রিটিক্যাল চ্যালেঞ্জ ইন এনসিউরিং হেলথ কেয়ার ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন।
গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন ফোরামের কনভেনার ডা. সৈয়দ রুবায়েত। তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে কম ব্যয় করে। চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গ্লোবাল হেলথ এক্সপান্ডিচার ডাটা বেইজ তথ্য বিশ্লষণ করে তিনি দেখান, ২০২১ সালে বাংলাদেশ একজন মানুষের পেছনে গড়ে ২৬ ডলার ব্যয় করেছে। এ সময়ে প্রতিবেশী মিয়ানমার ৪৮ ডলার ব্যয় করেছে। পাকিস্তানও নানা সংকটের মধ্যে ৪৯ ডলার ব্যয় করেছে। নেপালে ৭৬ ডলার, ভারতে ৮১ ডলার, শ্রীলঙ্কায় ২৮৩ ডলার জনপ্রতি ব্যয় করেছে। সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে মালদ্বীপ। তারা ওই বছর জনপ্রতি গড়ে এক হাজার ৪৭৯ ডলার ব্যয় করেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে কম সরকারি অর্থ ব্যয় করা ২০টি শীর্ষ দেশের মধ্যেও অন্যমত বাংলাদেশ। শীর্ষে রয়েছে দক্ষিণ সুদান। সেখানে মাথাপিছু প্রায় সাড়ে পাঁচ ডলার সরকার ব্যয় করে। এই সূচকে ২৬ ডলার ব্যয় করে বাংলাদেশও রয়েছে। কম ব্যয় করা তালিকায় থাকা অধিকাংশ দেশ আফ্রিকার।
তিনি বলেন, ২০২১ সালের তথ্যমতে, বাংলাদেশে এখন চিকিৎসা ব্যয়ের ৭৩ ভাগ রোগীকে বহন করতে হয়। ২০০০ সালে মোট ব্যয়ের ৬২ ভাগ রোগীকে বহন করতে হতো। এরপর প্রতিনিয়ত শুধু বাড়ছেই সূচক। অথচ আগামী ২০৩২ সালের মধ্যে আউট অব পকেট এক্সপান্ডিচার বা রোগীর ব্যয় কমিয়ে ৩২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। কিন্তু বাজেটে পর্যপ্ত বরাদ্দ নেই। এতে ধারণা করা যাচ্ছে এই লক্ষ্যমাত্র অর্জন করা কঠিন হয়ে যাবে।
তিনি তার বক্ত্যবে তুলে ধরেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, চিকিৎসা নিতে গিয়ে রোগীকে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করতে হয় বিশ্বের এমন ১০টি দেশের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। সবচেয়ে বেশি রোগীকে খরচ করতে হয় আর্মেনিয়াতে। সেখানে মোট ব্যয়ের ৭৯ শতাংশ রোগীকে বহন করতে হয়। মোট ব্যয়ের ৭৩ শতাংশ রোগীকে বহন করার ভার নিয়ে এই তালিকার ছয় নম্বরে রয়েছে বাংলাদেশ। রোগীর চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধির কারণে ৮ দশমিক ৬১ মিলিয়ন মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। এখন স্বাস্থ্য বাজেটের পরিমাণ বাড়াতে হবে। রোগীদের ঘাড় থেকে চিকিৎসা ব্যয়ের বোঝা কমাতে হবে।
ডেইলি স্টার বাংলার সম্পাদক গোলাম মর্তুজা বলেন, সরকারের তরফ থেকে বাজেট বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় না, কারণ তারা কেউ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করেন না। সামান্য অসুস্থ হলে তারা বিদেশে চিকিৎসা নেন। রাষ্ট্রের জনপ্রতিনিধি, আমরা দেশে চিকিৎসা গ্রহণ করলে চিকিৎসা ব্যবস্থার চেহারা এতদিনে বদলে যেত। বাজেটে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভিআইপিদের চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাত্রা বন্ধের দাবি তুলতে হবে।
কেয়ার বাংলাদেশের পরিচালক (স্বাস্থ্য ও পুষ্টি প্রোগ্রাম) ইখতিয়ার উদ্দিন খন্দকার বলেন, সারা দেশের সরকারি স্বাস্থ্যসেবার স্ট্রাকচার আরও উন্নত ও সম্প্রসারিত করতে হবে। রোগী ব্যবস্থাপনা ও সেবার পরিধি বাড়াতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলে রোগীর ওপর ব্যয়ের বোঝা কমানো সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, আমাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার একটি স্থাপনা রয়েছে। সেখানে সেবার পরিধি বৃদ্ধির বিষয়টিকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করতে হবে। তাহলে আউট অফ পকেট এক্সপান্ডিচার কমে আসবে।
প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি শিশির মোড়ল বলেন, রোগীর ঘাড় থেকে চিকিৎসা ব্যয়ের বোঝা কমাতে হলে বাজেট বরাদ্দের টাকা যথাযথভাবে ব্যয় করতে হবে। প্রতি বছর প্রায় আট হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে পারে না স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। ফলে ফেরত যায়। এমনিতে বরাদ্দ কম তার ওপর ফেরত যাওয়া অর্থ এর সঙ্গে আছে প্রচলিত দুর্নীতি। ফলে ব্যয়ের বোঝা শুধু বাড়ছে রোগীর ঘাড়ে। এই বিষয়ে মনিটরিং করতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারি ওষুধ উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ইডিসিএলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। কারণ আউট অব পকেট এক্সপান্ডিচারের বেশিরভাগ টাকা ব্যয় করতে হয় ওষুধ কিনতে। বছরে বিভিন্ন সময়ে বাড়ে ওষুধের দাম। সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় ওষুধের উৎপাদন বৃদ্ধি করলে ও বিনামূল্যে রোগীকে সরবরাহ করলে কমে আসবে রোগীর ব্যয়ের পরিমাণ।
হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক আঞ্চলিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. ইশরাত জাহান বলেন, জটিল রোগে ভুগছে দেশের ৪২ ভাগ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা। অন্যান্য সুস্থ মানুষের চেয়ে তাদের গড় আয়ু প্রায় ১০ থেকে ২০ বছর কম। কিন্তু বাজেটে তাদের চিকিৎসার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো বরাদ্দ কিংবা ব্যাখ্যা নেই। তাদের যথাযথ চিকিৎসা প্রাপ্তির জন্য স্বাস্থ্য বিমা চালু করা এখন সবচেয়ে জরুরি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, জনসংখ্যার অনুপাতে দেশে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন মোট বাজেটের প্রায় ১২ থেকে ১৫ শতাংশ। সেখানে আমরা এ বছর দেখছি প্রস্তাব করা হয়েছে মাত্র ৫.২ শতাংশ। মানসম্মত চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য এই অর্থ অপর্যাপ্ত। তারপর এখানে সমস্যা হলো প্রতি বছর অর্থ ফেরত যায়। সীমিত বরাদ্দের অর্থ কাজে লাগাতে পারে না মন্ত্রণালয়। এসব কারণে সেবার ব্যাপ্তি দিনে দিনে ছোট হচ্ছে আর রোগীর ঘাড়ে বাড়ছে ব্যয়। স্বাস্থ্যসেবাকে বিস্তৃত করতে হবে প্রান্তিকে। ওষুধের সরবরাহ আরও বাড়াতে হবে। তবেই রোগীর ব্যয়ের ভার কমবে।
গোল টেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাইনুল ইসলাম, আইসিডিডিআরবির বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. আহমেদ এহসানুর রহমান, নারী পক্ষের প্রকল্প পরিচালক সামিয়া আফরিন, কেয়ার বাংলাদেশের পরিচালক (স্বাস্থ্য ও পুষ্টি প্রোগ্রাম) ইখতিয়ার উদ্দিন খন্দকার, অবস্টেট্রিকেল অ্যান্ড গাইনিকোলজিকেল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সভাপতি হয়েছেন অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান, বাংলাদেশ উইমেন্স হেলথ কোয়ালিশনের (বিডব্লিউ এইচসি) নির্বাহী পরিচালক শরীফ মোস্তফা হেলাল, আরটিএমআই এর এক্সিকিউটিভ ব্রান্ড মেম্বার মাইশা কবির, আইন ও শালিস কেন্দ্রের প্রকল্প কর্মকর্তা শান্তা ইসলাম, নারী মৈত্রীর প্রোগ্রাম ম্যানেজার রেহানা আক্তার মিতা, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহসভাপতি ডা. মাখদুমা নার্গিস, আইপিএস বাংলাদেশের সিনিয়র টেকনিক্যাল এডভাইজার ফারহানা জেসমিন হাসান, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এবং সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) লিগ্যাল স্পেশালিস্ট আয়েশা আক্তার, মেরী স্টোপস এর কান্ট্রি ডিরেক্টর কিশওয়ার ইমদাদ, ব্র্যাকের প্রোগ্রাম প্রধান ডা. ইমরান আহমেদ চৌধুরী, আইপিএএস বাংলাদেশের পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. ওয়াহিদা সিরাজ, সিরাক-বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক এস এম সৈকত, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথের অধ্যাপক কাওসার আফসানা, ওজিএসবির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. সামিরা চৌধুরী এবং আইসিডিডিআরবির সিনিয়র ডাইরেক্টর এবং সিনিয়র সাইটিস্টি ডা. শামস এল আরেফিন প্রমুখ।
মন্তব্য করুন