সারা দেশে আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজা নির্বিঘ্নে ও উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপিত হওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে পূজার দিনগুলোতে সারা দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং ঢাকায় অন্তত রাত ১১টা পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু রাখার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ। সংগঠনটি বলেছে, দুর্গাপূজা নির্বিঘ্ন করতে অন্তর্বর্তী সরকার, সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের নানা পদক্ষেপে তারা আশ্বস্ত। তাদের সে অর্থে উৎকণ্ঠা নেই।
শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) সকালে শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ও মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পূজা পরিষদের নেতারা এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এবার ঢাকায় গতবারের তুলনায় ৭টি বেড়ে মোট ২৫৯টি মন্দির-মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। আর সারা দেশে মোট মন্দির-মণ্ডপের সংখ্যা ৩৩ হাজার ৩৫৫টি, যা গতবারের তুলনায় হাজারখানেকের বেশি।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব জানান, দুর্গাপূজার প্রস্তুতির মধ্যেই কয়েকটি জেলায় দুর্গাপ্রতিমা ও মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। জেলাগুলো হচ্ছে- কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহের শৈলকূপা, নেত্রকোনা, গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, জামালপুর, নাটোর, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
তিনি বলেন, পূজার মধ্যে আমরা এসব হামলা দেখতে চাই না। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদক্ষেপ নয়, রাষ্ট্রের আলোকিত চেতনা ও সামাজিক প্রতিরোধের মাধ্যমে এই সহিংসতার অবসান ঘটাতে হবে। একই সঙ্গে বলতে চাই, পূজার পাঁচ দিনের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবলে হবে না, বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ গড়তে চাইলে ৩৬৫ দিনের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হবে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ঘটাতে হবে। দুর্বৃত্তদের বিচারের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আমরা সেটাই দেখতে চাই।
মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির এই সভাপতি প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমরা এমন একটি সমাজের অপেক্ষায় আছি- যে সমাজে ঈদ, পূজা, বড়দিন, বুদ্ধ পূর্ণিমাসহ অন্যান্য ধর্মীয় ও সার্বজনীন সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো নির্বিঘ্নে, অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে, কোনো ধরনের ভয়-ভীতি ও পুলিশি পাহারা ব্যাতিরেকে অনুষ্ঠিত হবে।’ এর আগে গত মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে আসন্ন দুর্গাপূজায় দেশের বিভিন্ন জেলার সাত শতাধিক মন্দির-মণ্ডপকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করার কথা জানায় বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট।
লিখিত বক্তব্যে জয়ন্ত দেব সারাদেশে সুষ্ঠুভাবে পূজা উদযাপনে মণ্ডপ ও কমিটিগুলোর প্রতি ২২ দফা নানান নির্দেশনার কথা তুলে ধরেন। এ সময় ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ‘স্বার্থ ও অস্তিত্ব রক্ষায়’ আট দফা দাবির কথাও পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি।
দুর্গাপূজায় ঢাকা মহানগরসহ সারা দেশের প্রতিটি মন্দির-মণ্ডপে দুটি দাবি তুলে ধরার জন্য বলা হয়েছে বলে জানান জয়ন্ত দেব। দাবি দুটি হলো- সারা দেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নেতৃত্ব ও নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে অসত্য ও ঢালাও ভিত্তিহীন হয়রানিমূলক মামলা পূজার আগেই প্রত্যাহার করতে হবে। সরকারি ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জোরপূর্বক পদচ্যুতি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
গত রোববার মহালয়ার মধ্য দিয়ে শারদীয় দুর্গাপূজার প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। সংবাদ সম্মেলনে জয়ন্ত দেব বলেন, শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) বোধনের মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। এরপর রোববার মহাষষ্ঠী, সোমবার মহাসপ্তমী, মঙ্গলবার মহাঅষ্টমী, বুধবার মহানবমী অনুষ্ঠিত হবে। বৃহস্পতিবার বিজয়া দশমী ও প্রতিমা বিসর্জন। সেদিন বিকেল ৩টায় ঢাকাসহ সারা দেশে বিজয়ার শোভাযাত্রা শুরু হবে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর বলেন, আমাদের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা কিছু ছড়িয়ে দিয়ে, ধর্মবিদ্বেষের ভুয়া মিথ্যা একটা বার্তা দিয়ে যে হামলা করা হয়েছে, এটা ২০০৯-১০ সাল থেকে শুরু হয়েছে। সর্বশেষ রংপুরের গঙ্গাচড়ার ঘটনাটিসহ এসব হামলার ঘটনা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে ‘উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে’ তুলে ধরার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, তারা আমাদের বলেছেন- কঠোর অবস্থানে থাকবেন, আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। এর মধ্যে বেশকিছু এলাকায় প্রতিমা এবং মন্দিরে হামলার ঘটনার পর অনেক দুর্বৃত্ত ধরাও পড়েছে। বিশেষ করে সেনাবাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে ছুটে যাচ্ছে, প্রশাসনের পাশে দাঁড়াচ্ছে। আমরা এটাই চেয়েছিলাম যে, হামলার ঘটনার বিচার হচ্ছে কিনা, দুর্বৃত্তরা ধরা পড়ছে কিনা- এটাই আমাদের দেখার বিষয়। আমরা নানাভাবে গত ৫৩ বছর ধরে বিচারহীনতার সংস্কৃতি দেখেছি। আমরা চাই না যে, এই সংস্কৃতি অব্যাহত থাকুক।
বর্তমান পরিবর্তিত সময়ের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে এসব বিষয়গুলো স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ছাড়াও ধর্ম উপদেষ্টা, আইজিপি, মহানগর পুলিশ কমিশনার এবং বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠকে তুলে ধরা হয়েছে বলেও জানান পূজা উদযাপন পরিষদের এই সভাপতি। তিনি বলেন, তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন এবং তাদের আশ্বাসের বিভিন্ন প্রতিফলন আমরা দেখতেও পেয়েছি।
প্রতিমা বিসর্জন ও বিসর্জনের শোভাযাত্রা নিয়ে কোনো উৎকণ্ঠা রয়েছে কিনা- জানতে চাইলে বাসুদেব ধর বলেন, এটা যাতে সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়, আমরা তো সেটাই চাইব। সরকারও তাই চেয়েছে এবং একেবারে সর্বাঙ্গীন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কাজেই উৎকণ্ঠা আপনারা যেভাবে বলছেন, সে অর্থে উৎকণ্ঠা নেই। আমরা পূজার আয়োজন করছি, আমরা জানি- সবাই আমাদের পাশে রয়েছে।
এ সময় তিনি গত এক বছর ধরে ঢালাওভাবে মিথ্যা মামলার নামে সংখ্যালঘু নেতাদের অনেককে হয়রানি করা হচ্ছে মন্তব্য করে বলেন, এটা আমরা সরকারকে জানিয়েছি, সেনাবাহিনীকেও জানিয়েছি। বিভিন্ন জেলায় কিছু কিছু ঘটনা সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে নিরসন হয়েছে। আমরা চাই, যেগুলো এখনো হয়নি- সেগুলো সরকার এবং প্রশাসনের যেই অংশটি এটা দেখে, তারা যেন পূজার আগে দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করেন। বাসুদেব ধর বলেন, তাদের নেতারা এবং পূজা সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, মহানগর কমিটি ছাড়াও হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই এই মামলার শিকার হয়েছেন। তারা যেন নিশ্চিন্তে আসন্ন দুর্গাপূজায় অংশ নিতে পারেন, সরকারের কাছে সেই অনুরোধ জানাচ্ছি।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনি করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন আবার অতিরিক্ত কিছু করে না ফেলেন। তারা অবশ্যই আমাদের দেখভাল করবেন, কিন্তু অতিরিক্ত কিছু করতে গিয়ে আবার সাধারণ জনগণের মধ্যে, যারা বিভিন্ন মণ্ডপে যাতায়াত করেন পরিবার নিয়ে, তাদের মধ্যে যেন একটা ভয়-ভীতির সৃষ্টি না হয়। সেই ব্যাপারে একটু লক্ষ রাখতে হবে। এ সময় তিনি আসন্ন দুর্গাপূজা নির্বিঘ্নে ও উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপনে দেশের সব রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে পাড়া-মহল্লাকেন্দ্রিক নানা কার্যক্রমের জন্য অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানান।
ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির পরিচালনা কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরী বলেন, জাতীয় নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যারা এখানে (মন্দিরে) আসেন, যারা সবসময় সম্প্রীতির কথা বলেন, তাদের বলব- আপনারা এই সম্প্রীতির আহ্বান সারা বছরই সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে অব্যাহত রাখুন।
সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের নির্ধারিত এলাকার সব পূজামন্ডপে নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ও বৈঠক করছে বলেও জানান তিনি। তার প্রত্যাশা, এবার পূজায় আমরা সারা দেশের ১৮ কোটি মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে এই আনন্দের সাথে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করব। ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’- এটার পরিবর্তে ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ শীর্ষক অমোঘ বাণী চালু করার কথা জানিয়ে এর মাধ্যমে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেন সুব্রত চৌধুরী।
এবার দেবী দুর্গার আগমন হবে গজে অর্থাৎ হাতির পিঠে চড়ে। আর দশমীতে দেবী মর্ত্যলোক ছাড়বেন দোলা বা পালকিতে চড়ে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন- পূজা উদযাপন পরিষদের অন্যতম উপদেষ্টা কাজল দেবনাথ, পূজা উদযাপন পরিষদের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার, যুগ্ম সম্পাদক গোপাল চন্দ্র দেবনাথ, শুভাশীষ বিশ্বাস সাধন, পদ্মাবতী দেবী, বিপ্লব দে প্রমুখ।
মন্তব্য করুন