নারীদের জীবনে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরেও কিছু পরিবর্তন আসে— একটা সময় মাসিক চক্র বন্ধ হয়ে যায়, সন্তান ধারণের ক্ষমতা কমে যায়। এই স্বাভাবিক পরিবর্তনকে বলা হয় মেনোপজ।
এটা কোনো রোগ নয়। এটি নারীদের জীবনের এক নতুন অধ্যায়। তবে এই সময় শরীরে ও মনে নানা ধরনের পরিবর্তন হয়, যেগুলো সম্পর্কে জানা থাকলে এই সময়টা অনেক সহজ ও সুন্দরভাবে পার করা যায়।
চলুন, মেনোপজ সম্পর্কে সহজ করে জেনে নিই– কখন হয়, কেন হয়, কীভাবে বুঝবেন আপনি এই পর্যায়ে আছেন, আর কীভাবে এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভালো থাকা যায়।
মেনোপজ তখনই হয়, যখন নারীদের শরীরে ডিম্বাণু তৈরি হওয়া বন্ধ হয়ে যায় এবং টানা ১২ মাস মাসিক না হলে সেটাকেই মেনোপজ ধরা হয়। এর ফলে সন্তান ধারণের ক্ষমতা থাকে না। এই সময় শরীরে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের মতো হরমোন কমে যায়, যেগুলো নারীর প্রজননক্ষমতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
- বেশিরভাগ নারীর ৪৫-৫৫ বছর বয়সে মেনোপজ হয়
- সাধারণত ৫০ বছর নাগাদ এটি শুরু হয়
কেউ কেউ এর আগেও এই পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারেন
প্রাথমিক মেনোপজ : ৪০-৪৫ বছর বয়সে
অকাল মেনোপজ : ৪০-এর আগেই
মূলত বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নারীর দেহে হরমোনের ভারসাম্য কমে যায়। তবে কিছু কারণে মেনোপজ দ্রুত আসতেও পারে, যেমন :
- কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন থেরাপি
- তলপেটে চোট বা অপারেশন
আরও পড়ুন : হঠাৎ শরীর ফুলে যাচ্ছে? হতে পারে ভেতরে লুকানো বড় কোনো সমস্যা
আরও পড়ুন : ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানুন
- হরমোন থেরাপি
- জরায়ু বা ডিম্বাশয় অপসারণ
পেরিমেনোপজ : মাসিক অনিয়ম হতে শুরু করে। কখনো হয়, কখনো হয় না। হরমোনের ওঠানামা দেখা দেয়।
মেনোপজ : টানা ১২ মাস মাসিক না হলে ধরে নেওয়া হয় আপনি মেনোপজে প্রবেশ করেছেন।
পোস্টমেনোপজ : মেনোপজের পরবর্তী সময়, যেখানে উপসর্গ কমে আসে বা অন্য শারীরিক পরিবর্তন হয়।
প্রত্যেক নারী ভিন্নভাবে মেনোপজ অনুভব করেন। কারও কারও তেমন সমস্যা হয় না, আবার কারও ক্ষেত্রে বেশ কষ্টকর উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
শারীরিক লক্ষণ
- হট ফ্ল্যাশ (হঠাৎ গরম লাগা)
- রাতে ঘাম হওয়া
- ঘুমের সমস্যা
- ওজন বেড়ে যাওয়া
- চুল পড়া বা ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া
- যোনির শুষ্কতা ও যৌনমিলনে অস্বস্তি
- হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া
- হাড় ও গাঁটে ব্যথা
- ঘন ঘন প্রস্রাব বা ইনফেকশন
- স্তনে ব্যথা বা পরিবর্তন
মানসিক ও আবেগজনিত লক্ষণ
- মন খারাপ বা বিষণ্ণতা
- রাগ বা খিটখিটে মেজাজ
- ভুলে যাওয়া বা মনোযোগ কমে যাওয়া
- ক্লান্তি ও ঘুম কম হওয়া
- যৌন আগ্রহ কমে যাওয়া
- হঠাৎ মুড পরিবর্তন
- যদি উপসর্গগুলো আপনার স্বাভাবিক জীবনে সমস্যা তৈরি করে
- যদি ৪৫-এর আগেই মাসিক বন্ধ হয়ে যায়
- যদি খুব বেশি হট ফ্ল্যাশ, ঘুমের সমস্যা বা বিষণ্ণতা দেখা দেয়
- যদি প্রস্রাব বা যোনি সংক্রমণ বারবার হয়
ডাক্তার প্রাথমিক লক্ষণ দেখে ধারণা করতে পারেন। তবে নিশ্চিত হতে কিছু রক্ত পরীক্ষা করা যায়, যেমন:
- FSH টেস্ট: মেনোপজ হলে এই মাত্রা ৩০ mIU/mL বা তার বেশি হয়
- Estradiol (ইস্ট্রোজেন)
- থাইরয়েড, কিডনি, লিভার ফাংশন
- প্রোল্যাক্টিন, টেস্টোস্টেরন
- গর্ভাবস্থার সম্ভাবনা থাকলে HCG টেস্ট
চিকিৎসকের সহায়তায় যা করা যায়
- হট ফ্ল্যাশ কমাতে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট বা অন্যান্য ওষুধ
- যোনির শুষ্কতার জন্য টপিক্যাল হরমোন থেরাপি
- যৌনমিলনের সময় লুব্রিক্যান্ট ব্যবহার
- প্রয়োজন হলে হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (HRT)
এই চিকিৎসাগুলো সবার জন্য নয়, তাই ডাক্তারকে অবশ্যই জানান যদি অন্য কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা থাকে।
ব্যক্তিগত যত্ন
- প্রতিদিন ত্বকে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন
- সূর্য বা কেমিক্যালযুক্ত প্রসাধনী এড়িয়ে চলুন
- ঢিলেঢালা, হালকা কাপড় পরুন
- ঘর ঠান্ডা রাখুন, পাশে ছোট ফ্যান রাখুন
খাদ্য ও পুষ্টি
- ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি ও ম্যাগনেশিয়াম হাড়ের জন্য খুবই উপকারী
- ওমেগা-৩ (মাছ, চিয়া সিড, আখরোট ইত্যাদি) ঘাম ও হরমোনজনিত সমস্যায় সহায়ক
- চিনি ও ফাস্টফুড এড়িয়ে চলুন
ব্যায়াম
- সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট হালকা থেকে মাঝারি ব্যায়াম (হাঁটা, সাঁতার, সাইক্লিং)
- সপ্তাহে ২ দিন হালকা ওয়েট ট্রেনিং বা রেজিস্টেন্স ব্যায়াম
আরও পড়ুন : কোলেস্টেরল কমাতে পুষ্টিবিদের সহজ পরামর্শ
আরও পড়ুন : উপুড় হয়ে ঘুমান? জানুন এতে শরীরে কী হয়
- নিয়মিত ব্যায়ামে হাড় ও হৃদযন্ত্র ভালো থাকে
মানসিক যত্ন
- ধ্যান, শ্বাস-প্রশ্বাস অনুশীলন বা যোগব্যায়াম
- নিজেকে সময় দিন, নিজের পছন্দের কাজ করুন
- খুব প্রয়োজন হলে কাউন্সেলিং নিন
- আত্মীয়-স্বজন বা সাপোর্ট গ্রুপে যুক্ত থাকুন
অভ্যাসে পরিবর্তন আনুন
- ধূমপান বাদ দিন বা কমান
- অ্যালকোহল (সর্বোচ্চ দিনে ১ গ্লাস) সীমিত করুন
- রাতে ভালো ঘুমের ব্যবস্থা করুন
মেনোপজ জীবনের একটি স্বাভাবিক অধ্যায়। এটা মানে জীবনের শেষ নয়, বরং নতুন করে নিজেকে বুঝে নেওয়ার শুরু। একটু যত্ন আর সচেতনতায় এই সময়টা হয়ে উঠতে পারে অনেক সহজ ও সুন্দর।
আপনি একা নন— বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি নারী এই সময় পার করছেন। তাই প্রয়োজন হলে সাহস করে কথা বলুন, নিজের শরীরকে ভালোবাসুন, সাহায্য নিন।
সূত্র : হেলথলাইন
মন্তব্য করুন