আজ ২২ অক্টোবর ২০২৫ তারিখ– পৃথিবীর ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় শুরু হলো। বাংলাদেশ সমগ্র বিশ্বকে নতুন করে দেখিয়ে দিল, অপরাধ করলে অপরাধীকে তার ফল ভোগ করতেই হবে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়; ক্ষমতার দাপটে আর অস্ত্রের জোরে কেউ আজীবন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে পারে না, জালেম কখনো স্থায়ী হতে পারে না।
প্রথমেই মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি, স্বৈরাচারমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি আজ জালেমদের আইনের মুখোমুখি করতে আমাকে সাহায্য করার জন্য। শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সাথে ধন্যবাদ জানাই জুলাই বিপ্লবের যোদ্ধাদের– শহীদ ও গাজি – যাদের ত্যাগের ফলে বাংলাদেশ আজ পুনর্জন্ম লাভ করেছে, আমারও পুনর্জন্ম হয়েছে। ধন্যবাদ জানাই মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, অ্যাডভোকেট তাজুলের নেতৃত্বে একঝাঁক নিবেদিতপ্রাণ প্রসিকিউটরকে, গুম কমিশনকে এবং সর্বোপরি ট্রাইব্যুনালের মাননীয় বিচারপতিগণকে।
পৃথিবীর ইতিহাসে ২৫ জন সামরিক কর্মকর্তাকে, যার মধ্যে ১৫ জন কর্মরত, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে বেসামরিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি হবার নজির সম্ভবত এটাই প্রথম। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে ‘আইনের শাসন’ প্রতিষ্ঠায় এটা এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
আমাকে গুম করে দীর্ঘ ৮ বছর ডিজিএফআইয়ের তথাকথিত আয়নাঘরে বন্দি করে রাখার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করার ব্যাপারে প্রাথমিক পর্যায়ে আমি কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত গত ডিসেম্বর ২০২৪-এ আমি ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করি। প্রাথমিক তদন্তের পর আমার বন্দিকালীন ডিজিএফআইয়ের যে পাঁচজন ডিজি ছিলেন তাদের সবার বিরুদ্ধেই গত ৬ জানুয়ারি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তবে, তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হলেও তার আগেই তারা পালিয় যায়। বিস্তারিত তদন্তে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলে গত ৮ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে ২৫ জন অফিসারের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি হয়। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী আজ (বুধবার) অভিযুক্ত অফিসাররা আদালতে হাজিরা দিলে মাননীয় আদালত তাদের কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ প্রদান করেন।
এই বিবৃতির মাধ্যমে আজ (বুধবার) আমি দেশবাসীকে আমার অভিযোগ দায়েরের উদ্দেশ্য জানাতে চাই। আমি কোনো প্রতিহিংসা বা জিঘাংসা চরিতার্থ করার জন্য কিংবা প্রতিশোধের উদ্দেশ্য নিয়ে ট্রাইব্যুনালে এই অভিযোগ করিনি। যারা দেশের ভবিষ্যৎ সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান হবেন কিংবা বিভিন্ন বাহিনী প্রধান হবেন তাদের একটা বার্তা দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই আমার এই অভিযোগ।
অভিযুক্ত ব্যক্তিরা যেন জুলুমের শিকার না হয় সেটা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সুবিচার নিশ্চিত করা গেলে যে ধরনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি অভিযুক্ত ব্যক্তিরা পাবেন বলে ধারণা করা যায়, তাতে করে যারা ভবিষ্যতে সরকার পরিচালনা করবেন তারা কখনো স্বৈরাচার হবার মতো ধৃষ্টতা দেখাবেন বলে মনে করি না। পাশাপাশি, জেনারেলরাও অন্যায় কাজে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি অন্ধ আনুগত্য করে সংবিধানের প্রতি শপথভঙ্গ করে কোনো আইনবহির্ভূত কাজে লিপ্ত হওয়ার মতো ধৃষ্টতা দেখাবার সাহসও করবে না।
এই বিচার ভবিষ্যৎ সরকার প্রধান ও জেনারেলদের জন্য (সেই সাথে বিভিন্ন বাহিনী প্রধানদের জন্যও) সামরিক পরিভাষায় যাকে ডেটারেন্ট (deterrent) অর্থাৎ ‘প্রতিরোধক বা প্রতিবন্ধক’ হিসেবে কাজ করবে বলে আমি মনে করি। একটি সুখী, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে, বৈষম্য-জুলুম-নির্যাতন-গুম-খুনের সংস্কৃতিমুক্ত একটি কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে এই মামলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এটাই আমার আশা ও উদ্দেশ্য।
লেখক : ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুল্লাহিল আমান আযমী
মন্তব্য করুন