ডা. রুবায়ুল মোরশেদ, চিকিৎসক, গবেষক
প্রকাশ : ০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৫:৫৭ পিএম
আপডেট : ০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৬:১৭ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

‘দয়া হলো সেই ভাষা যা অন্ধরা দেখতে পায় এবং বধিররাও শুনতে পারে’

‘দয়া হলো সেই ভাষা যা অন্ধরা দেখতে পায় এবং বধিররাও শুনতে পারে’

সুখ অর্জনের জন্য ‘উদারতা’ উপাদানটি সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। আর সুখই হলো মানুষের অস্তিত্বের পরম লক্ষ্য। একজন দয়ালু ব্যক্তির জন্য উদারতা এক বিশাল অদৃশ্য শক্তি। আমেরিকান সাহিত্যের জনক মার্ক টোয়েন একবার বলেছিলেন, ‘দয়া হলো সেই ভাষা যা অন্ধরা দেখতে পায় এবং বধিররাও শুনতে পারে’। আমরা ধনী, তারকা এবং ক্ষমতাবানদের প্রশংসা আর পূজা করতেই পছন্দ করি বেশি। ভুলে যাই সমাজ এবং বিশ্বে সদয় ব্যক্তিদের পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা করতে। ভুলে যাই তাদের বিশাল অবদানকে। উদারতা, কৃতজ্ঞতা কিম্বা নম্রতাকে দুর্বলতা হিসেবে উপেক্ষা করি। অথচ এসব গুণাবলি এক একটি অদৃশ্য শক্তিশালী অস্ত্র যে গুণগুলো একটি সমাজ ও আমাদের চারপাশকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে।

এটি সেরকম ৯ জন দয়ালু মহিলার সম্পর্কে একটি দুর্দান্ত গল্প, যারা প্রায় পঁয়ত্রিশ বছরের বেশি ধরে চুপচাপ এক অসাধারণ কাজ করে চলেছেন। গোপনে অসচ্ছল আর দুঃখী মানুষদের দিকে তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আপস করেননি উদাসীন সমাজের সাথে, ভালো কাজে একটু ক্লান্তও হননি সময়ে অসময়ে। এই ৯ জন বয়স্ক মহিলার দলটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি রাজ্যে বাস করেন। জায়গাটি আমেরিকার দীর্ঘতম মিসিসিপি নদীর কাছে এবং পশ্চিম টেনেসি নদী উপত্যকায় অবস্থিত। পঞ্চাশোর্ধ এই নয় মৃদুভাষী অত্যন্ত বিনয়ী এবং নিরহঙ্কারী। কারও কারও বয়স আজ সত্তর পেরিয়েছে। ৯ নিবেদিত প্রাণের মধ্যে চারজনই আপন বোন যারা তাদের পিতামাতা এবং ঘরের বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এই মহৎ কাজে। একদম শুরুতেই চার বোন মিলে এক সকালে একসাথে বসে এই অভিনব মানবদরদি সিদ্ধান্ত নেন। যা সময়ের স্রোতে ৯ জনের একটি দরদি দল হয়ে ওঠে। যা এখন তো এক নতুন ইতিহাস। এই বিদুষী মহান ৯ জনকে ‘৯ নানা (The 9 Nanas) নামে এখন পৃথিবীর অনেকেই চেনেন।

এক সপ্তাহের জন্য যেখানে কোনো কথা গোপন রাখা সহজ নয়; এটি আশ্চর্যজনক- এই মহিলাদের দলটি ত্রিশ বছর ধরে তাদের ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে এই অসামান্য ভালো কাজটির কথা গোপন রেখেছিলেন। তারা প্রথম প্রথম চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলেন। এই উদ্দেশে যে কীভাবে তারা সবার প্রতি আরও একটু বেশি দয়ালু হতে পারেন! মহিলারা কয়েক দশক ধরে এমন গোপনীয়তা ধরে রেখেছিলেন যা তাদের স্বামীরাও জানত না। যখন তাদের পরিবারের আপনজনরা ঘুমিয়ে, সেই ভোর ৪টায় শুরু হয় তাদের দিন। বছরের পর বছর ধরে তাদের স্বামী-সন্তানসহ কাউকে না জানিয়ে এই আচারটি করে আসছিলেন তারা। সেই নিস্তব্ধ ভোর-রাতে শুরু হতো তাদের সামাজিক ন্যায়বিচারের কার্যক্রম। অনুকূল প্রতিকূল আবহাওয়ায় তারা নিয়ম করে প্রতিদিনই দেখা করেন। ৯ জন নানাই প্রথমে খুঁজে খুঁজে বের করেন, কোনো দুঃখী ব্যক্তি কোথায় কখন থাকেন বেনামে বিল পরিশোধ করা থেকে অভাবি লোকদের জন্য কাপড় কেনা ছাড়াও তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যবস্থা করে থাকেন। নিরিবিলি সময়ে তারা পালাক্রমে অসচ্ছল এলাকাগুলো ঘুরে বেড়াতেন, কার কেমন অবস্থা তা পরখ করবার জন্য। কার ঘর অন্ধকার আর কার ঘরে কতটুকু অভাব তা বোঝার চেষ্টা করতেন চুপিচুপি। পথের মুসাফির থেকে যে কোনো গৃহহীনদের অবস্থার খবর নিতেন একটু বেশি করেই। প্রতিটি কেয়ার প্যাকেজে বাড়িতে তৈরি কেকের সাথে থাকে ছোট একটি একান্ত ‘নোট’ যাতে বলা থাকে, ‘কেউ আপনাকে ভালোবাসে’। সেই প্যাকেজে যতটুকু সম্ভব অসহায়দের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস দিতে চেষ্টা করা হয়। তার অর্থ সংগ্রহ ও সঞ্চয়ের বিভিন্ন কৌশলের ওপর ভর করে দিনে দিনে স্থিতিশীলও হয়ে ওঠেন। যেমন তারা তাদের নিজস্ব লগ্নি নিজেরাই করা শুরু করেন এবং সেখান থেকে সঞ্চিত অর্থ তাদের ভালো কাজে লাগান। মাঝে মাঝে তাদের প্যাকেটের সংখ্যা বেড়ে যেত অনেক। পোস্টাল এবং ইউপিএস চালক, যারা তাদের কাছ থেকে সে প্যাকেটগুলো তুলে নিত তাদের ধারণাও ছিল না যে তারাও এই দয়ালু নারীদের মহান কাজের অংশীদার হচ্ছেন।

তাদের এই গোপনে দাতব্য দান করার জীবন ভালোই কাটছিল। একদিন একজনের স্বামী কিন্তু ঠিকই সন্দেহ করলেন। ৯ জনই বুঝলেন এখন সময় হয়েছে আপনজনদের জানাবার। ত্রিশ বছর পর ‘মেরি এলেন’ নামে এক নানার বাসায় তারা সবাই বসবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তার বসার ঘরে সবাই তাদের স্বামীদের ডাকলেন, জড়ো করলেন একসাথে এবং তারা যা যা এতদিন ধরে করে আসছিলেন তা তাদের স্বামীদের সাথে ‘শেয়ার’ করলেন অকপটে। প্রথমে বিস্মিত হলেও, তারা অসন্তষ্ট হলেন না এই ভালো কাজটি করতে দেখে। তারাও সবাই এ কাজে নিজেদের জড়াতে চাইলেন। ধীরে ধীরে আজ অনেকেই জানেন ৯ নানার প্রতিদিনের গল্পগুলো। যা মাঝে মাঝে রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। এই মহিলারা আধুনিক দিনের সবাই রবিন হুড। শুধু পার্থক্য হলো, তারা নিজেরাই দিনের পর দিন বিভিন্ন কৌশলে ধীরে ধীরে সঞ্চয় করেন এবং তারপর তাদের সঞ্চিত সেই অর্থ ব্যয় করেন অসহায় অভাবীদের সাহায্য করার জন্য। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তারা যা করে চলেছেন তা সত্যিই একটি আদর্শ মানদণ্ড, সবারই সেখান থেকে শেখার আছে আনকে কিছু। সত্যিই স্বীকৃতি ছাড়া বাঁচতে শেখা এক ধরনের অসাধারণ দক্ষতা।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

চুরি যাওয়া জিনিস প্রধান শিক্ষককে কিনে দিতে বললেন শিক্ষা অফিসার

মানিকগঞ্জে চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন পাইলট অসিম জাওয়াদ

পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকদের বাড়িতে হামলা, মুক্তিযোদ্ধাসহ আহত ৫

তালতলী উপজেলা চেয়ারম্যান পদে লড়বেন স্বামী-স্ত্রী

সুবর্ণচর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন সাবাব

চলাচলের রাস্তায় ঘর নির্মাণ করলেন আ.লীগ নেতা

মা দিবস উপলক্ষে বিএনপি কার্যালয়ে খালেদা জিয়ার ছবি সম্বলিত ব্যানার

সুনামগঞ্জে আগুনে পুড়ল ৫ দোকান

জামিন পেলেন সেই ৫ প্রিসাইডিং কর্মকর্তা

২০ মিনিটের ঝড়ে লণ্ডভণ্ড বোয়ালমারী-আলফাডাঙ্গা

১০

দুই তরুণীকে নিয়ে পালানো সেই ছাত্রলীগ নেতাকে অব্যাহতি

১১

সিগারেটের বাক্সের লোভে ভাতিজার গলা কাটল চাচা

১২

১১ ঘণ্টা পর বিধ্বস্ত বিমান উদ্ধার

১৩

ধানকাটা নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ১৫

১৪

বিয়ের দাবিতে প্রেমিকের বাড়িতে তরুণী, পালালেন তারিকুল

১৫

যৌতুকের জন্য তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বাকে হত্যা

১৬

নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা / চেয়ারম্যানের হামলায় ছাত্রলীগ নেতা আহত

১৭

রংপুরে ইয়াবাসহ ইউপি সদস্য গ্রেপ্তার

১৮

পঞ্চগড়ে বিএনপি নেতার সংবাদ সম্মেলন

১৯

মৌলভীবাজারে জামানত হারালেন আ.লীগ নেতা

২০
X