তাত্ত্বিক পদার্থবিদ জে রবার্ট ওপেনহাইমারের (যাকে ‘পারমাণবিক বোমার পিতা’ বলে ডাকা হয়) আত্মজীবনীনির্ভর সিনেমা এটি। ক্রিস্টোফার নোলানের সর্বশেষ এ অসাধারণ এবং অদম্য কাজটিকে ‘বায়োপিক’ বললে এর লক্ষ্য ও সমগ্রতা পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ পায় না। ওপেনহাইমার বিবিধ জটিল সময়রেখায় সংগঠিত প্রগাঢ় ও জমাটবদ্ধ সময়ের আখ্যান। সিনেমাটি কোর্টরুম ড্রামা, রোমান্টিক যোগাযোগ, ল্যাবরেটরিতে হঠাৎ আবিষ্কার করা কোনো বিষয়—লেকচার হলের বিখ্যাত কাল্ট চরিত্রের সমন্বয়ে গঠিত। কিন্তু সবকিছুর ঊর্ধ্বে ওপেনহাইমার একটি চূড়ান্ত পর্যায়ের দানবীয় চলচ্চিত্র। ওপেনহাইমার পারমাণবিক যুগের ফ্রাঙ্কেস্টাইন; একজন মানুষ যিনি বিজ্ঞানের অনন্ত সম্ভাবনার বন্দিদশা থেকে মুক্ত হতে পারছেন না। যিনি এটা বুঝতে দেরি করে ফেলেছেন, তার আবিষ্কার সীমাহীন ধ্বংসের ক্ষমতা রাখে। শেষপর্যন্ত এই গল্পে দানবটি ওপেনহাইমারের আবিষ্কার নয় বরং মানবজাতির ভেতরে হত্যার যে ক্ষুধাকে জাগিয়ে দেয়—দানব সেটা। ধীরে ধীরে সিনেমাটি ভাঁজ খুলতে শুরু করলে ওপেনহাইমারের শঙ্কাময় মুখমণ্ডল ও তার ভীতি আমাদের এক উপলব্ধির মুখোমুখি করে। মার্ফির দূরদর্শী বরফশীতল চোখের এত ভালো ব্যবহার এর আগে কখনো হয়নি।
আরও ভালো করে বললে, মার্ফির শারীরিকতা সার্বিকভাবে পুরো সিনেমার নিষ্পতিতে সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছে। সে দেখতে তাত্ত্বিকভাবে গড়ে ওঠা কোনো চরিত্রের মতো। তার সঙ্গে কাজ করা বলিষ্ঠ মারকুটে সামরিক চরিত্রগুলোর আশপাশে অবাস্তব রকমের হালকা দেখায় (উদাহরণস্বরূপ ম্যাট ডেমনের কথাই ধরা যাক—লেফটেন্যান্ট জেনারেল গ্রোভসের চরিত্র যাকে দেখে মনে হবে তিনি ঘুসি মারার জন্য কিছু খুঁজছেন)।
শুরুর দিকের একটি শটে দেখা যায়, ওপেনহাইমার নতুন ক্লাসরুমে হাতভর্তি বই নিয়ে ঢুকছেন, তখন তাকে দেখে মনে হচ্ছে—হয়তো আরোহিত জ্ঞানের ভারেই তিনি নুয়ে পড়েছেন। সিনেমায় অন্যান্য সময়ে তাকে অত্যন্ত শান্ত সৌম্য দেখায়। যিনি কোনোভাবে অহমমুক্ত একজন মানুষ এবং যেসব আইডিয়া তাকে চূড়ান্ত অস্ত্রটি বানাতে সাহায্য করবে সেগুলোর উত্তাপ থেকে মুক্ত।
ওপেনহাইমারের যে সংস্করণ আমরা স্ক্রিনে দেখছি, যে কোনো সময়ের জন্যই এটি স্মারকের মতো এবং আমরা কোন সময়রেখায় আমাদের বসতি গড়ে তুলেছি তার নির্দেশক। ওপেনহাইমারের জীবনের শুরুর দিকে বর্ণাঢ্য প্রাতিষ্ঠানিক ক্যারিয়ার ছিল। পরে অপমানজনক এবং নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট ছাড়পত্রের শুনানি বিলীন করে দিয়েছে তার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপকে। ম্যানহাটন প্রজেক্টের আওতায় বোমাটির নির্মাণে ফেডারেল সরকারের একটি পদে লুইস স্ট্রস (অসাধারণ- রবার্ট ডাউনি জুনিয়র) থাকবেন কিনা সেটি নিয়ে যখন আবার সিনেটে শুনানি হয়, তখনো তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হন ওপেনহাইমার। এটা সংগঠনের গেরোময় একটি জাল। ওপেনহাইমার সিনেমায় ‘সময়’ সবসময় সরলরৈখিক নয়। এখানে এমন কিছু মুহূর্ত রয়েছে যেখানে আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করার দৃশ্য রয়েছে যা পুরো সিনেমা থেকে আলাদা মনে হয়েছে। নোলানের সিনেমা পুরোপুরি জট খোলার জন্য সাধারণত কয়েকবার দেখতে হয়। ‘টেনেট’-এর মতো ওপেনহাইমারেও সময় নিয়ে দ্বন্দ্ব—চূড়ান্ত দন্দ্ব না হলেও আলাদা কিছু নয়।
আরও কিছু সমস্যা রয়েছে—যেমন নারী চরিত্রগুলোকে ভাসা ভাসাভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। ওপেনহাইমারের রক্ষিতা জ্য ট্যাটলকের চরিত্রে ফ্লোরেন্স পিউ অভিনয় করেছেন, যাকে সিনেমায় খুব কম সময়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে দেখা যায়। এমিলি ব্লান্ট অভিনয় করেছেন ওপেনহাইমারের স্ত্রী কিটি চরিত্রে। তাকে সিনেমার প্রথম দুই ঘণ্টাজুড়ে স্ক্রিনের কোনায় বিদ্রোহী ভঙ্গিতে শক্ত করে মার্টিনির গ্লাস ধরে রাখতে দেখা যায়। কিন্তু পরে তিনি ভয়ংকর কিছু মুহূর্তের অবতারণা করেন। একটি লোমহর্ষক জিজ্ঞাসাবাদের দৃশ্যে—যখন তিনি একজন অসৎ সহকর্মীর দিকে শব্দহীন দৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে থাকেন। তখন তার চোখে যে শত্রুতার আগুন দেখা যায় তা দর্শকের মনে সম্পূর্ণরূপে পারমাণবিক শীত নামিয়ে আনে।
তবে সিনেমার বেশিরভাগ অংশের জন্য এটা বলাটাই সমীচীন হবে—এটি একটি সুউচ্চ প্রাপ্তি। এটি মোটেও অবাক করা বিষয় নয়; ছবিটির দৃশ্যধারণে নোলান কেন আইম্যাক্স ৭০ এমএম ফিল্ম ব্যবহার করেছেন। ফলে ছবিগুলোতে সবকিছু এতটাই বিশদ ও বিস্তারিতভাবে দেখা যায় দর্শক সিনেমাটির মধ্যে ডুবে যেতে পারবেন। অসামান্য এই বিজ্ঞানীর চরিত্রকে সিনেম্যাটিক মাজেজায় সূচিত করতে ব্ল্যাকবোর্ডে ইচ্ছেমতো দাগ টানার উত্তেজনাময় দৃশ্যের কোনো অভাব নেই। কিন্তু সবচেয়ে আগ্রহোদ্দীপক ছবিটির বিমূর্ত দৃশ্যগুলো। এটা অনেকটা এমন অনুভূতি তৈরি করে, দেখে মনে হবে আমরা পরমাণুর হৃদয়ের মধ্যে ঢুকে পড়ছি। সিনেমায় দুশ্চিন্তার মুহূর্তে পুরো সেট যেভাবে নড়ে ওঠে, সে বিষয়টিও সমানভাবে উদ্ভাবনী। তার আবিষ্কারের প্রতিক্রিয়ায় যে শকওয়েভ সৃষ্টি হয়েছে, আক্ষরিক অর্থেই ওপেনহাইমারের জগত তাতে কেঁপে উঠেছে। সর্বোপরি, মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছে সিনেমাটির ক্যারিশম্যাটিক শব্দ ও সুরের ঝঙ্কার। জোনাথন গ্লেজারের আসন্ন সিনেমা ‘দ্য জোন অফ ইন্টারেস্ট’-এর মতো এ সিনেমাটিতে যুদ্ধের ভয়াবহতা সরাসরি দেখানো না হলেও—আমাদের কানে আসা শব্দের মাধ্যমে অনিবার্যভাবে তা ঠিকই প্রকাশ পেয়েছে। ওপেনহাইমারে লুডউইগ গোরাসনের সুর নিপুণ ও পারদীয় শোনায়। অবশ্যই এ বছরের অন্যতম সেরা কাজের একটি এটি। তার শব্দ-সুরলহরীতে এক ধরনের পুনরাবৃত্তি রয়েছে যা ক্রমাগত চড়া হয়ে আমাদের ভেতরে বিদ্যুতায়িত অবস্থার তৈরি করে। ওপেনহাইমারের ক্যারিয়ার যখন উচ্চ অবস্থানে ছিল, তখনকার গৌরবময় মুহূর্ত থেকে নেওয়া হয়েছে এ শব্দগুলো। কিন্তু তা ভিন্ন দিকে এক ভীতিময় মোড় নেয়—যখন মেধাবী এই পদার্থবিজ্ঞানীর সর্বনাশা কর্মকাণ্ড ক্রমে জগতবাসীর কাছে পরিষ্কার হতে শুরু করে।
মূল লেখা : ওয়েন্ডি অ্যাডে, দ্য অবজারভারের সহকারী সিনেমা সমালোচক
গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর : সরকার জারিফ
মন্তব্য করুন