রহমান মৃধা
প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৩, ০৪:৩৪ পিএম
আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:২৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
রহমান মৃধার নিবন্ধ

জাতিসংঘের পরিবর্তন ঘটানো সময়ের দাবি

ছবি : সৌজন্য
ছবি : সৌজন্য

জাতিসংঘের সৃষ্টি করা হয়েছিল বিশ্বে শান্তি ও সহযোগিতার জন্য, কিন্তু আজকের বিশ্বে এর কার্যকারিতা এবং ভূমিকা বিতর্কের বিষয়। বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তন অথবা অবসান ঘটানোর এখনই গুরুত্বপূর্ণ সময়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্বনেতারা। জাতিসংঘের কাজ শান্তির জন্য কাজ করা, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। গ্লোবাল পলিসি ফোরাম সংস্থার একটি হিসাব অনুযায়ী, জাতিসংঘের সমগ্র কর্মকাণ্ডের বার্ষিক ব্যয় প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার। জাতিসংঘের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার এবং শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করার কারণ কি নেই? বিশ্ব যখন মার্কিন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতিনিধিত্ব করে এবং গণতন্ত্রকে উন্নীত করতে সাহায্য করে সে সম্পর্কে কথা বলে তখন এটি আকর্ষণীয় শোনায়। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে, গণতন্ত্র প্রবর্তনের জন্য দেশে তাদের হস্তক্ষেপ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে, লাখ লাখ মানুষ সন্ত্রাস ও ভীতি প্রদর্শনের শিকার হয়েছে। এটি গুরুতর সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে গোটা বিশ্বের জন্য।

দীর্ঘ ছয় বছর (১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল) পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। বিজয়ী মিত্রশক্তি পরবর্তীকালে যাতে যুদ্ধ ও সংঘাত প্রতিরোধ করা যায় এই উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়। তখনকার বিশ্ব রাজনীতির পরিস্থিতি জাতিসংঘের সাংগঠনিক কাঠামোতে এখনও প্রতিফলিত হয়ে চলেছে।

উদাহরণস্বরূপ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫টি স্থায়ী সদস্যদের ভেটো প্রদানের ক্ষমতা। এই পাঁচটি দেশ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া এবং গণচীন। এর কারণ হলো এরা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী দেশ।

অক্টোবর ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা ১৯৩টি। এর সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে অবস্থিত। সাংগঠনিকভাবে জাতিসংঘের প্রধান অঙ্গ-সংস্থাগুলো হলো সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ, সচিবালয়, ট্রাস্টিশিপ কাউন্সিল এবং আন্তর্জাতিক আদালত। এ ছাড়াও রয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনেস্কো, ইউনিসেফ ইত্যাদি।

জাতিসংঘের প্রধান নির্বাহী হলেন এর মহাসচিব। কথিত রয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন সমস্যা এবং শত কোটি মানুষের জীবনের মান উন্নয়নে জাতিসংঘের মহাসচিব এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আর তাই এই কাজের জন্য সেরা ব্যক্তিটিকে বেছে নেওয়া জরুরি। কিন্তু জানেন কী এ নির্বাচন প্রক্রিয়া গোপনীয় এবং সেখানে মাত্র ৫টি রাষ্ট্র সিদ্ধান্তের ক্ষমতা রাখে? এটা আমাদের সবাইকে প্রভাবিত করে।

ভেটো কী এবং কে বা কারা ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এবং কেন?

ভেটো ইংরেজি শব্দ। এর মানে বাধা। ভেটো হচ্ছে একপক্ষীয়ভাবে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, দেশের মনোনীত প্রতিনিধি কর্তৃক কোনো সিদ্ধান্ত বা আইনের ওপর স্থগিতাদেশ প্রদান করা।

অবশ্যম্ভাবী শব্দ হিসেবে ভেটো শব্দটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ব্যাপকভাবে পরিচিত ও এটি বৈশ্বিকভাবে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া এবং ফ্রান্স এই ৫টি দেশের প্রত্যেকেই ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারী। এর মাধ্যমে যে কোনো একটি দেশ নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত যে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আইন প্রণয়ন অনুমোদনে বাধা প্রদান করতে পারে।

যার কারণে অন্য সব দেশ প্রস্তাবের পক্ষে থাকলেও কোনো কাজ হয় না। যেমন গণহত্যাসংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলো ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে বিধায় অনেক সমস্যার কোনো সমাধান নেই। নিরাপত্তা পরিষদের ৫টি স্থায়ী সদস্য দেশ বেসামরিক মানুষদের রক্ষার চেয়ে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ বা ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেয়। সেক্ষেত্রে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বেসামরিক মানুষদের রক্ষায় দারুণভাবে ব্যর্থ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর এভাবেই চলছে জাতিসংঘের কাজ। বিশ্ব রাজনীতিতে জোর যার মুল্লুক তার (might is right) কনসেপ্ট ব্যবহৃত হচ্ছে। যার ফলে বাংলাদেশের মতো দেশের তেমন কোনো ক্ষমতা নেই জাতিসংঘে প্রভাব বিস্তার করা।

নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটিয়ে ধর্ম, বর্ণ, ভাষার দোহাই দিয়ে গণতন্ত্রের শাসন কায়েম করা সম্ভব হবে না। বরং দুর্নীতির অবসান ঘটাতে হবে। সন্ত্রাস দূর করার জন্য বিশ্বে অপারেশন ক্লিনহার্ট, এনকাউন্টার, ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ইত্যাদি চালানো হচ্ছে। জঙ্গিবাদ দমনের জন্য বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জঙ্গিবাদবিরোধী যুদ্ধে শামিল থাকার চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে।

এভাবে সমস্যার কোনো সমাধান হতে পারে না। বিশ্বে দিনে দিনে প্রতিশোধমূলক আচরণ এবং ঘৃণার বীজ বিশাল আকারে প্রভাব ফেলছে। এখন সময় এসেছে বুঝে শুনে কাজ করার। গণতন্ত্রের বিকল্প নেই কিন্তু কীভাবে তা পাওয়া সম্ভব? স্বল্প সময়ে সবকিছু সহজে ফিরে পাওয়া যাবে না। কারণ উপরের বর্ণনায় বিশ্ব রাজনীতির অবস্থা এতটাই দুর্বল, ন্যায়বিচার থেকে শুরু করে কোনো ভালো কিছুই আমরা আশা করতে পারি না। সেক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের সমস্যার সমাধান নিজেদেরই করতে হবে।

গোটা বিশ্ব এখন নানা সমস্যার মাঝে হাবুডুবু খেতে শুরু করেছে। গ্লোবালাইজেশন এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। বিশ্ব ভাবতে শুরু করেছে কীভাবে প্রযুক্তিকে আরও জোরাল করা এবং সেই সঙ্গে মানুষের ফিজিক্যাল মুভমেন্ট বন্ধ করা যায়।

গ্লোবালাইজেশনের অবসান ঘটাতে হলে গ্লোবাল মুভমেন্টের বন্ধ করতে হবে। তা কি আদৌ সম্ভব এখন? ধর্ম, রাজনীতি, বর্ণ ভাষাগতভাবে মানুষ জাতি চেষ্টা করেছে পৃথিবীতে স্থিতিশীলতা আনতে, সম্ভব হয়নি। এখন কী করা বাকি রয়েছে বা আমাদের কী করণীয় যদি একটি সুন্দর পৃথিবী পেতে চাই?

আমি মনে করি নিজ নিজ জায়গা থেকে পরিবর্তন আনতে হবে। Agree to disagree concept-এ বিশ্বাস আনতে হবে। দরিদ্রতা দূর করতে হবে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ কমাতে হবে, respect and be respected, accept and be accepted কনসেপ্টের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। ভিক্ষা, ধার বা অনুদান কখনও স্বাধীনতা দিতে পারে না।

সর্বশেষে জাতিসংঘের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। যেমন ৫টি সুপার পাওয়ার নয়, ১৯৩টি দেশের সমন্বয় ঘটাতে হবে সব ধরনের সিদ্ধান্তে, তা না হলে সত্যের জয় কখনও হবে না। সেক্ষেত্রে বলা যেতে পারে বর্তমানে জাতিসংঘ বিশ্ব সমস্যার সমাধানে ‘গুড ফর নাথিং’ ভূমিকা পালন করছে। সেক্ষেত্রে ভুল হবে কী যদি বলি জাতিসংঘের পরিবর্তন ঘটাতে হবে আর তুলে নিতে হবে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা।

রহমান মৃধা : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দ্বিতীয় দিনের মতো কাকরাইল মোড়ে জবি শিক্ষার্থীরা, সড়ক অবরোধ

ঢাবি ভিসি-প্রক্টরের পদত্যাগ দাবিতে ছাত্রদলের অবস্থান

শেষ বাঁশিতে ক্ষুব্ধ মেসি, সান হোসের সঙ্গে গোলবন্যায় ড্র মায়ামির

মাহফুজের মাথায় বোতল নিক্ষেপ, অভিযুক্ত যুবককে খুঁজছে পুলিশ

নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে গেল যাত্রীবোঝাই বাস

দিনাজপুর সীমান্তে ‘ভারতীয় ড্রোন’ উদ্ধার

রাজধানীর যেসব স্থানে বসবে কোরবানির পশুর হাট

ইউএনওর কাছে অভিযোগ করায় সহকর্মীকে বেধড়ক মারধর

ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন / শ্রমিক পাঠানোয় নানা অভিযোগের তদন্ত বন্ধে বাংলাদেশকে মালয়েশিয়ার চিঠি

দেশের জনগণ বারবার ফ্যাসিবাদের উত্থান দেখতে চায় না : আলী রীয়াজ

১০

শেষের ক'ম্যাচে ৬ কোটি রুপি! মোস্তাফিজ আসলে কত পাবেন?

১১

আজও ঢাকার দুই স্থানে সড়ক অবরোধ

১২

সরকারি প্রাথমিকের ডিপিএড-সিইনএড শিক্ষকদের জন্য বড় সুখবর 

১৩

রাতের আঁধারে ফিলিং স্টেশনে দুর্বৃত্তদের আগুন

১৪

সাড়ে ৭ মাসে কোরআনে হাফেজ হলো ১৩ বছর বয়সী সাইফুদ্দিন

১৫

হাতিরঝিলে ভাঙা সীমানা দ্রুত মেরামতের নির্দেশ রাজউক চেয়ারম্যানের

১৬

দুই দেশের বৈঠক : ১২ লাখ শ্রমিকের ভাগ্য নির্ধারণ আজ

১৭

ইশরাককে মেয়র পদে বসানোর দাবিতে দ্বিতীয় দিনের মতো সড়কে অবস্থান

১৮

‘হতাশায় মোদি’ নিতে পারেন বেপরোয়া সিদ্ধান্ত, সতর্ক পাকিস্তান

১৯

দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে মাদককারবারি নিহত

২০
X