থিতিনান পংসুধিরক
প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৪, ০৩:৫১ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে

মিয়ানমার জান্তার পতন হতে যাচ্ছে?

একটি সামরিক ঘাঁটি দখলের পর মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা। ছবি : সংগৃহীত
একটি সামরিক ঘাঁটি দখলের পর মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা। ছবি : সংগৃহীত

প্রায় অর্ধ শতাব্দীকালের সামরিক স্বৈরশাসনের পর উদারবাদী রাজনীতির আলো দেখা গিয়েছিল মিয়ানমারে। ১৯৬২ সালে শুরু হওয়া সেনাশাসনের অবসান ঘটিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করেছিলেন অং সাং সু চি। অং সাং সু চির সেই নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে ২০১১ সালে। কিন্তু ২০২১ সাল পর্যন্ত মাত্র ১০ বছর স্থায়ী হয় এই সরকার।

ফেব্রুয়ারি ১, ২০২১। সিনিয়র জেনারেল মিন-অং-হ্লাইং মিয়ানমারের পুনঃনির্বাচিত বেসামরিক সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেন। মিয়ানমারে সূচনা হয় গৃহ-যুদ্ধের। দেশটির তরুণরা, জাতিগত-সংখ্যালঘু, সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য, বেসামরিক নেতারা এবং একটি বিদ্রোহী জনগোষ্ঠী ক্ষমতাসীন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করা এসব গোষ্ঠী সম্প্রতি তাদের লড়াইকে বিপ্লব হিসেবে অবিহিত করছে। তারা অনেক জায়গায় যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয় অর্জন করেছে এবং সংঘর্ষের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে পরাজিত করা এক জিনিস; আর জাতিগতভাবে বিভক্ত একটি দেশে জনপ্রিয়, বৈধতা পাওয়া ও একটি কার্যকর বহুত্ববাদী রাষ্ট্র পুনর্গঠন করা একেবারেই অন্যরকম।

মিয়ানমারের এই মারাত্মক অভ্যন্তরীণ সংঘাত কয়েক মাস ধরে চলতে পারে। কারণ সেনাবাহিনী টিকে থাকার জন্য বিমান শক্তি, সাঁজোয়া যান এবং আর্টিলারি সাজিয়ে রাজধানীসহ প্রধান শহরগুলোতে অবস্থান নিয়েছে। এবং শহরগুলোর চারপাশে অবস্থান নিয়েছে বিদ্রোহীরা।

বিশ্বের অন্যতম কঠোর জান্তা সরকার হিসেবে পরিচিত মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনীকে আগের চেয়ে অনেক দুর্বল দেখা যাচ্ছে। পূর্বে ৫,০০,০০০-শক্তিশালী সামরিক বাহিনী এখন প্রায় ১,৫০,০০০-এ এসে ঠেকেছে। স্বায়ত্তশাসন চাওয়া জাতিগত সংখ্যালঘুদের পক্ষে অস্ত্র ধরা মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে লড়াই করে বেশ প্রভাব ধরে রেখেছিল মিয়ানমার সামরিক বাহিনী। কিন্তু এবার তারা ভুল লক্ষ্য বেছে নিয়েছে।

অভ্যুত্থানের পরের সপ্তাহগুলোতে জাতীয় বিক্ষোভ শুরু হলে বিক্ষোভ দমনে সশস্ত্র বাহিনীকে গুলি চালানোর নির্দেশ দেয় মিয়ানমার জান্তা। সরকারি সৈন্যরা তাদের নিজস্ব লোকদের ওপরেই বন্দুক চালায় এবং নির্বিচারে শত শত সাধারণ বার্মিজকে হত্যা করে। জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে গণঅসন্তোষ তৈরি হয় এবং গণঅসন্তোষ রূপ নেয় গৃহযুদ্ধের।

মূলত বার্মিজ তরুণরাই এই প্রতিরোধ যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে। যে বয়সে তাদের পড়াশোনা, উন্নত জীবনযাত্রার মানের চিন্তা এবং জীবন নিয়ে প্রত্যাশা তৈরির সময় ছিল সেই বয়সে হাতে অস্ত্র তুলে নেয় তারা। দেশব্যাপী তারা পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) ইউনিটে সংগঠিত হয়। প্রাথমিকভাবে বাড়িতে তৈরি অস্ত্র এবং অন্যান্য সাধারণ অস্ত্র নিয়েই জান্তা শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। কিন্তু পরে তারা জাতিগত মিলিশিয়াদের সঙ্গে একত্রিত হয় এবং অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।

তারা আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে পরিচিত বেসামরিক নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (NUG)-এর সাথে সমন্বয় করে কাজ করে। EAOS এবং PDF স্কোয়াডগুলো গেরিলা কৌশলের পাশাপাশি প্রচলিত যুদ্ধ কৌশল ব্যবহার করেও শাসক বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাচ্ছে। অভ্যুত্থানের মাত্র এক বছরের মধ্যে তারা দেশব্যপী জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণকে অচল করে দিতে সক্ষম হয়েছে।

জান্তা শাসকের বিরুদ্ধে এই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ প্রতিরোধ ক্রমবর্ধমানভাবে শক্তিশালী হচ্ছে এবং বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তারা সেনাবাহিনীকে হটিয়ে দিচ্ছে। তাদের এই সফলতার মূল কারণ- সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ বর্বরতা জান্তার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিদ্রোহকে উসকে দিয়েছে। মিয়ানমারের বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ এই প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। সমস্ত ফ্রন্টে আক্রমণের ফলে সেনাবাহিনীর শক্তিক্ষয় হচ্ছে। নতুন নিয়োগ না পাওয়া ও সরবরাহের অভাবে জান্তা বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়েছে।

বিদ্রোহীরা সবচেয়ে বড় সফলতাটি পায় দুই মাস আগে। বিদ্রোহী গোষ্ঠী ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স, মিয়ানমারের ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি, তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি এবং আরাকান আর্মি সমন্বিতভাবে অপারেশন ১০২৭ পরিচালনা করে। এই অপারেশনের মাধ্যমে তারা মিয়ানমারের উত্তর রাজ্যে দুই ডজনেরও বেশি শহরে একযোগে আক্রমণ চালায়। চীনের সীমান্তবর্তী শান শহরসহ শত শত সামরিক ফাঁড়ি দখল করে নেয় তারা।

কায়াহ, চিন, রাখাইন এবং কাচিন রাজ্যের অন্যান্য প্রতিরোধ কলামেও অগ্রগতি অর্জন করে বিদ্রোহীরা। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের অগ্রগতি সামরিক বাহিনীর দুর্বলতাকে জোরদার করে তুলেছে এবং প্রতিরোধ শক্তির আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে। এখন মনে হচ্ছে জান্তার পতন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।

থিতিনান পংসুধিরক : থাইল্যান্ড চুলালংকর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুষদের একজন অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অফ সিকিউরিটি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো।

ভাষান্তর - মুজাহিদুল ইসলাম

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৩ প্যাকেট কাঁচা নুডলস খেয়ে ১৩ বছরের কিশোরের করুণ পরিণতি

তিস্তার বন্যায় কৃষকের স্বপ্ন ভাসছে অনিশ্চয়তার অথৈ জলে

ব্যাংকিং টিপস / ব্যাংকের সুদের হার ও চার্জ সম্পর্কে সচেতন থাকুন

শতভাগ লুটপাটমুক্ত দল জামায়াতে ইসলামী : ড. মোবারক

মায়ের মৃত্যুর খবর শুনে হাসপাতালে এসে মারা গেলেন ছেলেও

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের বার্তা

সিঙ্গারে চাকরির সুযোগ, দ্রুত আবেদন করুন

মেসিহীন মায়ামিকে বাঁচাল রদ্রিগেজের দুর্দান্ত গোল

গাজায় যেভাবে দুর্ভিক্ষ নেমে এলো

লেভান্তের মাঠে বার্সার রোমাঞ্চকর জয়

১০

যুবদল নেতাকে কুপিয়ে হত্যা

১১

আকিজ গ্রুপে চাকরি, বেতন ছাড়াও থাকবে নানা সুবিধা 

১২

বাগেরহাটে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল

১৩

যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন তৈরি করছে ভারত

১৪

২৪ আগস্ট : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৫

নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে জনগণ বিএনপিকে বিজয়ী করবে : মোমিন

১৬

দুপুরের মধ্যে যেসব জেলায় হতে পারে বজ্রবৃষ্টি

১৭

বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় কলেজছাত্রীর কাণ্ড

১৮

রোববার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

১৯

২৪ আগস্ট : আজকের নামাজের সময়সূচি

২০
X