অভিন্ন দাবি নিয়ে রাজপথে থাকলেও দেশে সক্রিয় ইসলামী দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি দূর হচ্ছে না। আলাদা প্ল্যাটফর্মে থেকেই রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছে তারা। ‘তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি’ হওয়ার লক্ষ্যে সব ইসলামী দল নিয়ে আলাদা জোট গড়ার উদ্যোগ থাকলেও নানা কারণে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এর মধ্যে আবার আগামী নির্বাচনকে ঘিরে লাভ-ক্ষতির হিসাবনিকাশে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কোনো কোনো দলের নেতারা। এসব সত্ত্বেও বেশিরভাগ ইসলামী দল বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরকারবিরোধী আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনীতিতে নানমুখী সমীকরণ হচ্ছে। দল গুছিয়ে নিজেদের মতো ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একদফা দাবিতে আন্দোলনে রয়েছে বিএনপি ও এর মিত্র দলগুলো। এই পরিস্থিতিতে বসে নেই বেশিরভাগ ইসলামী দলও। একই প্ল্যাটফর্মে না থাকলেও বেশিরভাগ দলই আলাদা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে সক্রিয়। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে রাজনীতিতে ইসলামী দলগুলোর সক্রিয়তা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশে ইসলামী দলগুলো নানাভাগে বিভক্ত। চিন্তাচেতনার দিক থেকে এসব দলের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। যেমন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর আদর্শগত পার্থক্য রয়েছে। আবার খেলাফত মজলিশের সঙ্গে জামায়াত এবং জামায়াতের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশেরও মতপার্থক্য রয়েছে। এভাবে সব ইসলামিক দলের চিন্তাচেতনায় কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে সব ইসলামী দলকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া চললেও তা বাস্তবে রূপ নেয়নি। ইসলামী দলগুলো তাদের মতপার্থক্য কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়েকটি আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছে বলে জানা গেছে। এই প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা, অভ্যন্তরীণ ছোট ছোট বিভক্তিগুলো কেটে যাবে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সব ইসলামী দলের একটি ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম তৈরি হবে বলে তাদের আশা। সেই প্ল্যাটফর্মের মূল লক্ষ্য হবে সরকার পতনের আন্দোলন এবং বাংলাদেশকে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র বানানো। বিভিন্ন পর্যায়ে সেই প্রক্রিয়া চলমান আছে বলে একাধিক সূত্র দাবি করলেও প্রকাশ্যে কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইতোমধ্যে বেশিরভাগ ইসলামী দল নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদসহ নানা ইস্যুতে রাজপথে সক্রিয় আছে। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী চলতি মাসের শেষে ধারাবাহিক কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে ফের মাঠে নামবে। ৩ মাসের কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে মাঠে সক্রিয় আছে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন। আগামীকাল শনিবার ঢাকায় মহাসমাবেশ করবে খেলাফত মজলিশ। ঢাকায় আবারও ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলন করার ঘোষণা দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।
আবার নির্বাচন সামনে রেখে নিবন্ধিত কোনো কোনো ইসলামী দল ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সখ্য বাড়াতেও ব্যস্ত রয়েছে বলেও জানা গেছে।
কয়েকটি ইসলামী দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরেই দেশে ইসলামী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে একই প্ল্যাটফর্মে আনার প্রক্রিয়া চলছে। ইসলামী ও সমমনা ৯টি দল নিয়ে জোট গঠনে তৎপর রয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। এ ছাড়া পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে ‘অরাজনৈতিক’ সংগঠন হেফাজতে ইসলাম এবং আরও কয়েকটি ইসলামী রাজনৈতিক দল।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ৯টি ইসলামী ও সমমনা দল নিয়ে জোট গঠনের চেষ্টা করছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, খেলাফত মজলিশ, নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, এবি পার্টি, এনডিপি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (মনসুরুল-ইকরাম) ও এনডিএফের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন উদ্যোক্তারা। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবির বিষয়ে প্রায় সব ইসলামী দলই মোটামুটি একমত। চলমান প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় এসব দলের মধ্যে জোট অথবা নির্বাচনী সমঝোতা হতে পারে।
বর্তমানে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মোট সংখ্যা ৪৪টি। এর মধ্যে ইসলামী বা ইসলামপন্থি দলের সংখ্যা ১০টি। নিবন্ধন না থাকা ইসলামী দল বা সংগঠন কতগুলো—এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ইসলামী দলগুলো হলো ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, জাকের পার্টি ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি মাসের শেষ দিকে লাগাতার কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার চিন্তা করছে জামায়াতে ইসলামী। ইতোমধ্যে সারা দেশে দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির সাত দফা দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে। গতকাল সারা দেশের মহানগরগুলোতে বিক্ষোভ করেছে দলটি। এরপর জামায়াতের শ্রমিক সংগঠনের উদ্যোগে সমাবেশ হবে। তারপর ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ এবং কেন্দ্রীয়ভাবে কর্মসূচি দেবে জামায়াতে ইসলামী। এভাবে সরকারকে চাপে রাখার পরিকল্পনা দলটির।
জামায়াতের দুজন নায়েবে আমির ও তিনজন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কালবেলাকে বলেন, ‘বর্তমান সরকারের সীমাহীন লুটপাট ও ব্যর্থতায় দেশের মানুষ অতিষ্ঠ। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ নানা ইস্যুতে মানুষ দিশেহারা। আবারও যেনতেনভাবে নির্বাচন করে ক্ষমতায় যেতে ষড়যন্ত্র করছে সরকার। কিন্তু এবার অতীতের মতো ভোট করতে পারবে না ক্ষমতাসীনরা। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ একাধিক জনস্বার্থ ইস্যুতে কয়েকদিনের মধ্যেই নতুন কর্মসূচি দেওয়া হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, ‘ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো একই প্ল্যাটফর্মে বা জোটে না থাকলেও অভিন্ন দাবিতে রাজপথে সক্রিয় আছে।’
জানা গেছে, লাগাতার কর্মসূচি দিয়ে মাঠে সক্রিয় আছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ১৬ জুলাই থেকে দেশের সব থানা ও উপজেলায় দলটি ৬ শতাধিক ‘তৃণমূল প্রতিনিধি সম্মেলন’ করেছে। সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত সব জেলা ও মহানগরে সমাবেশ এবং ওলামা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া অক্টোবর মাসজুড়ে প্রতিটি জেলা ও মহানগরে ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলন ও সিরাতুন্নবী মাহফিল, ১ থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত থানা-উপজেলায় ইমাম, মুয়াজ্জিন ও ওলামা সম্মেলন এবং ডিসেম্বরজুড়ে সারা দেশে তাফসিরুল কোরআন মাহফিল ও গণ-কোরআন শিক্ষা কর্মসূচি পালন করবে চরমোনাই পীরের দল।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন দৈনিক কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা দলীয় কর্মসূচি নিয়ে সারা দেশে সক্রিয় আছি। আগের তুলনায় সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা বেড়েছে। বর্তমান সরকারের পতনের দাবিতে আমরা অটল আছি।’
দেশের ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো কেন একই প্ল্যাটফর্মে আসছে না—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই এই উপমহাদেশে রাজনীতিতে এলিট শ্রেণি তৈরি করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। তখন থেকেই এই শ্রেণিকে রাজনীতিতে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়। অন্যদিকে আলেম-ওলামাদের ভাবা হয় তারা শুধু মসজিদ-মাদ্রাসা নিয়ে কাজ করবে। কিন্তু সেই ধারণা ভ্রান্ত। আলেম সমাজ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিতে পারে। তবে দেশের বাস্তবতায় নানা কারণে আলেম সমাজের মধ্যে অনীহা আছে। আমরা অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রক্রিয়া চলমান আছে। ইনশাআল্লাহ, আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারব।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পূর্বঘোষিত ১৩ দফা দাবি, নেতাকর্মীদের মুক্তি এবং মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আগামী ২৮ অক্টোবর ঢাকায় ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলন করতে চায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। এ বিষয়ে একাধিক প্রস্তুতি সভা করেছেন সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা। গত বৃহস্পতিবারও কেন্দ্রীয় নেতারা বৈঠক করেছেন।
জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুহিউদ্দিন রাব্বানী গতকাল বৃহস্পতিবার দৈনিক কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা সরকারের প্রতি নেতাকর্মীদের মুক্তি এবং মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। আমাদের আগের ১৩ দফা, নেতাকর্মীদের মুক্তি এবং মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ২৮ অক্টোবর ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলন হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দেশে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন আদর্শ থাকলেও তারা জাতীয় ইস্যুতে অনেক সময় ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়। এটা পুরোনো রেওয়াজ। সুতরাং আগামীতে হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
মন্তব্য করুন