ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনে সমাপ্তি হলেও পদে পদে থেকে গেছে তাদের পদচিহ্ন। ভারতবর্ষে ব্রিটিশটা যে স্থাপনাগুলো রেখে গেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো তৎকালীন ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতায় নির্মিত ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। ৯৪ বছর বয়সে ১৯০১ সালে মহারানি ভিক্টোরিয়া মারা যান। তার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য তাজমহলের মতো এক বিকল্প স্থাপনা নির্মাণের চিন্তা থেকেই সাদা মার্বেল পাথরের এই স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয়। লর্ড কার্জন এই স্মৃতিসৌধটি নির্মাণের পরিকল্পনা করেন।
এই স্থাপনাটি ঘিরে রয়েছে বিশাল বাগান। মূল স্থাপনার ভেতরে রয়েছে ব্রিটিশ শাসনের স্মৃতিবাহী নানা সামগ্রী সমৃদ্ধ একটি জাদুঘর। জাদুঘরটি সোমবার ছাড়া বাকি দিনগুলোতে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। স্থাপনাটিকে ঘিরে থাকা বিশাল বাগানের অংশ সপ্তাহে সাত দিনই সকাল সাড়ে ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। কলকাতার ঘুরতে যাওয়া পর্যটকদের ভিড় সারা বছর এখানে লেগেই থাকে। দর্শনার্থীদের উপস্থিতি বিবেচনায় এটি বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত একটি জাদুঘর। ২০১৪ থেকে ২০১৫ সালে এই জাদুঘরটিতে ৩৪ লাখ দর্শক উপস্থিত হয়েছিলেন। বর্তমানে এটি ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি সায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান।
১৯০৬ সালের ৪ জানুয়ারি এই ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করা হলেও নির্মাণকাজ শেষে ১৯২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর এটি উদ্বোধন করা হয়। প্রিন্স অফ ওয়েলস হিসেবে ভারত সফরে আসা রাজা পঞ্চম জর্জের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন এবং ১৯২১ সালে প্রিন্স অফ ওয়েলস ও পরবর্তীকালের রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড স্থাপনাটি উদ্বোধন করেন।
এখানে নিয়মিতভাবে শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের ওপর বক্তৃতা, সেমিনার ও ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজনের মাধ্যমে এখানে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস উদযাপন করা হয়ে থাকে।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল স্মৃতিসৌধটিতে শঙ্কর রীতির বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটেছে। মুঘল রীতির গম্বুজ, তাজমহলের ন্যায় সাদা মার্বেলের ব্যবহার, ইতালীয় রীতির মূর্তি, সুউচ্চ উন্মুক্ত স্তম্ভশ্রেণি। সবকিছু মিলিয়ে ইউরোপীয় রীতির সাথে ইন্দো-ইসলামিক রীতির মিশ্রণে এটি ঔপনিবেশিক স্থাপত্য শৈলীর এক অপূর্ব নিদর্শন। ভারতে আধুনিক স্থাপত্যরীতির পথ নির্দেশক ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ভারতে ইউরোপীয় স্থাপত্য রীতির শ্রেষ্ঠ নির্দশন।
এই স্থাপনাসৌধটির নকশা করেন ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টের প্রেসিডেন্ট স্যার উইলিয়াম এমারসন। এর নির্মাণকাজ তত্ত্বাবধান করেন ভিনসেন্ট এশ। পরে এশকে সরকারিভাবে প্রকল্পের সুপারিনটেন্ডেন্ট আর্কিটেক্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি ছিলেন বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার। এর নির্মাণের দায়িত্ব প্রাপ্ত হয় কলকাতার মেসার্স মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি।
এর গঠন প্রক্রিয়ায় তাজমহলের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। যেমন : এর গম্বুজ, পার্শ্ববর্তী ক্লাস্টার্ড অষ্টভুজাকার গম্বুজ ছত্রী, সুউচ্চ জাঁকালো প্রবেশ তোরণ, উন্মুক্ত চত্বর, গম্বুজ আচ্ছাদিত কর্নার টাওয়ার ইত্যাদি। এমনকি এই দুই স্থাপত্যের উদ্দেশের মধ্যেও সাদৃশ্য বিদ্যমান। তাজমহলের মতো এটিও একজন সম্রাজ্ঞীর স্মৃতির উদ্দেশে নির্মিত।
৬৪ একর জমির ওপর লন, পুকুর, গুল্মরাজি ও লতাপাতায় ঘেরা বিশাল উন্মুক্ত অঙ্গনে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালটি স্থাপিত। কলকাতায় এরকম মনোরম উন্মুক্ত অঙ্গন দ্বিতীয়টি নেই। ভবনটির দৈর্ঘ্য ১০৩.০২ মিটার, প্রস্থ ৬৯.৪৯ মিটার এবং ‘অ্যাঞ্জেল অব ভিক্টরি’ মূর্তি পর্যন্ত এর উচ্চতা ৫৬.০৮ মিটার। মূর্তিটি আরও ৪.৮৮ মিটার উঁচু। মেমোরিয়াল নির্মাণে ব্যয়িত মোট ১ কোটি ৫ লাখ রুপির সবটাই সংগৃহীত হয়েছে ব্যবসায়ী ও ভারতের রাজন্যবর্গের স্বেচ্ছাপ্রদত্ত অর্থ থেকে।
এই স্থাপনাটি তৈরিতে মার্বেল সংগ্রহ করা হয়েছিল রাজস্থানের মাকরানা থেকে। এখান থেকেই সম্রাট শাহজাহান তাজমহলের জন্য মার্বেল সংগ্রহ করেছিলেন।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল অনেকগুলো গ্যালারির সমন্বয়ে গঠিত। এখানে সারাবছর বিভিন্ন অস্থায়ী প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়ে থাকে। ‘কুইন্স হল’টি আকর্ষণের মূল কেন্দ্র। এর সকল দেওয়ালে মহারানির ঘোষণা লিপিবদ্ধ রয়েছে। তার স্মৃতি বিজড়িত বিভিন্ন ঘটনার অঙ্কিত চিত্র দ্বারা গ্যালারি সজ্জিত। রানির ব্যবহূত কিছু সামগ্রী, যেমন- শৈশবে ব্যবহূত তার পিয়ানো, উইন্ডসোর প্রাসাদে দৈনন্দিন চিঠিপত্র লেখার জন্য ব্যবহৃত তার টেবিল ও চেয়ার, ভারতীয় প্রজাদের উদ্দেশ্যে লেখা তার শেষ চিঠি ইত্যাদি রয়েছে এখানে।
মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে আরও আছে বিভিন্ন সময়ে ভারতবর্ষে আসা বিখ্যাত ব্রিটিশ নাগরিকদের প্রতিকৃতি। যেমন : মেকলে, কিপলিং, বিশপ হেবার, উইলিয়ম হিকি প্রমুখ। নিজ যোগ্যতায় ভারতীয় কিছু ব্যক্তিও এখানে স্থান করে নিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন কেশবচন্দ্র সেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তার পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। কিছু দলিলপত্রও এখানে সংরক্ষিত আছে, এর মধ্যে রয়েছে। এ ছাড়াও আছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্মৃতিবাহী বিভিন্ন নিদর্শনাদি, যেমন- রানি মেরি, পঞ্চম জর্জ ও অন্যদের আবক্ষ মূর্তি, ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে দখলকৃত ফরাসি কামান ইত্যাদি।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে প্রধান আকর্ষণীয় বস্তু হলো রানি ভিক্টোরিয়ার বিষণ্ণ বিশাল একটি মূর্তি। এর দুদিকে রয়েছে দুটি সৃদুশ্য জলাশয়। ভারত শাসনকারী অনেক শাসকই রোমান রীতির পরিচ্ছদাবৃত হয়ে এখানে প্রস্তর মূর্তিতে উপস্থাপিত হয়েছেন। যেমন- লর্ড ক্লাইভ, ওয়ারেন হেস্টিংস, কর্নওয়ালিস, ওয়েলেসলি ও লর্ড ডালহৌসি।
এমারসনের নকশা অন্যান্য আরও অনেকের সংযোজন দ্বারা আরও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়েছে। ভিনসেন্ট এশের প্রধান অবদান হলো উদ্ভাবনী আদর্শের দ্বারা পরিবর্তিত ভিত্তি-নকশা। তবে তিনি প্রধান প্রবেশ তোরণের ভাস্কর্যসমূহ নির্মাণ, উত্তরাংশের অসাধারণ সেতুর নকশা প্রদান, ফটক ও বাগিচার মনোরম অলঙ্করণও তত্ত্বাবধান করেছিলেন। প্রশস্ত ও মনোরম বাগান ভবনের সৌন্দর্যকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বর্তমানে বহু চিত্রকর্ম, প্রাচীন পোশাক-পরিচ্ছদ ও ভারতে ব্রিটিশ শাসনামলের বহু স্মৃতি বহন করে চলেছে। সব মিলিয়ে এখানে বর্তমানে ২৮,৩৯৪টি বিভিন্ন নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। বর্তমানে কলকাতায় পর্যটকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল।
মন্তব্য করুন