যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করবে যুক্তরাষ্ট্র। শুনতে অবাক লাগলেও এমনই এক বাস্তবতা তৈরি করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এটা কোনো সাই-ফাই সিনেমার কাহিনি নয়, বরং এমন এক রাজনৈতিক পরিস্থিতির ইঙ্গিত, যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্য ও সিদ্ধান্ত দেশটির ভেতরেই বিভেদ ও সংঘাতের সম্ভাবনা তৈরি করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিলে তার পরিণতি পারমাণবিক সংঘাতের চেয়েও মারাত্মক হতে পারে, যা মুহূর্তেই ধসে দিতে পারে পশ্চিমা সাম্রাজ্যের স্থিতিশীল ভিত্তি।
বিপত্তির শুরু ট্রাম্পের এক মন্তব্যের থেকে। ২০১৯ সালে ট্রাম্প আলোচনায় আনেন এক বিস্ময়কর প্রস্তাব, যুক্তরাষ্ট্র গ্রিনল্যান্ড কিনতে চায়। বিশ্বের অনেকেই তা নিছক রসিকতা হিসেবে দেখলেও ট্রাম্প নিজের অবস্থানে অনড় ছিলেন। ডেনমার্ক প্রস্তাবটি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলে ট্রাম্প ক্ষুব্ধ হন।
২০২৪ সালের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসার পর আবারও গ্রিনল্যান্ড ইস্যু উত্থাপন করেন, তবে এবার আরও কঠোর ও আগ্রাসী ভাষায়। তিনি বলেন, প্রয়োজনে সামরিক বাহিনী ব্যবহার করেও গ্রিনল্যান্ড দখল করা হতে পারে। বিষয়টি তখন আর কৌতুকের পর্যায়ে থাকেনি, বরং রূপ নেয় এক মারাত্মক আন্তর্জাতিক সংকটে।
গ্রিনল্যান্ড বর্তমানে ডেনমার্কের অন্তর্গত এবং আন্তর্জাতিক আইনে যুক্তরাষ্ট্রের সেখানে হস্তক্ষেপের কোনো অধিকার নেই। কিন্তু ইতিহাস বলছে, ১৯৫১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ডেনমার্কের মধ্যে একটি সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার আওতায় যুক্তরাষ্ট্র গ্রিনল্যান্ডে একটি স্থায়ী সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে এবং অঞ্চলটির নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়।
পরিস্থিতির জটিলতা এখানেই। যদি ট্রাম্প সত্যিই সেনাবাহিনী পাঠিয়ে গ্রিনল্যান্ড দখলের চেষ্টা করেন, তাহলে দ্বিধাবিভক্ত অবস্থায় পড়বে যুক্তরাষ্ট্রেরই সেনাবাহিনী। কারণ একদিকে থাকবে প্রেসিডেন্টের নির্দেশ- গ্রিনল্যান্ডে আক্রমণের, অন্যদিকে থাকবে ১৯৫১ সালের চুক্তি অনুযায়ী সেই অঞ্চলের নিরাপত্তা রক্ষার বাধ্যবাধকতা। তখন যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা একে অপরের মুখোমুখি হওয়ার মতো অস্বাভাবিক বাস্তবতায় পড়তে পারে।
এই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে যদি গ্রিনল্যান্ডে মোতায়েন মার্কিন সেনারা আক্রমণ এড়িয়ে চলতে চান, অথচ নতুন করে পাঠানো বাহিনী প্রেসিডেন্টের আদেশে আক্রমণ চালায়। তখন সংঘাত শুধু অভ্যন্তরীণই থাকবে না, বরং আন্তর্জাতিক মাত্রাও পাবে। ডেনমার্ক নিশ্চয়ই একা দাঁড়িয়ে থাকবে না; তারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সহায়তা চাইবে।
কিন্তু সেখানেও এক বিশাল সমস্যা : যুক্তরাষ্ট্র নিজেই ন্যাটোর অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য। ফলে একদিকে যুক্তরাষ্ট্র গ্রিনল্যান্ডে হামলা চালাচ্ছে, অন্যদিকে একই যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর মাধ্যমে আক্রমণ প্রতিরোধে অংশ নিতে বাধ্য। এই দ্বৈত ভূমিকা স্পষ্ট করে দেয় যে, বিষয়টি আর কেবল একটি দ্বিপক্ষীয় বিরোধ নয়, বরং একটি পূর্ণমাত্রার ‘আন্তঃপশ্চিমা সংঘর্ষ’-এর দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
যদিও ট্রাম্পের গ্রিনল্যান্ড দখলের হুমকি এখনো বাস্তবে রূপ নেয়নি, এটি ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গ্রিনল্যান্ডের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়েছে। বরফ গলতে থাকায় নতুন শিপিং রুট, খনিজসম্পদ ও সামরিক কৌশলগত অবস্থানের কারণে এটি হয়ে উঠেছে এক ‘হটস্পট’।
এই অঞ্চল নিয়ে চীন, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিযোগিতা ক্রমেই বাড়ছে। আর ট্রাম্পের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের হঠাৎ সিদ্ধান্ত এই উত্তেজনাকে আরও জ্বালানি জোগাতে পারে।
গ্রিনল্যান্ডের মতো একটি শান্ত ও বরফাচ্ছন্ন অঞ্চল নিয়ে সংঘাতের আশঙ্কা একসময় অসম্ভব মনে হলেও, বর্তমান বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে তা আর কল্পনার বাইরে নয়। ট্রাম্পের মতো নেতার অধীনে যুক্তরাষ্ট্র যদি নিজের পুরোনো চুক্তি উপেক্ষা করে আক্রমণাত্মক পথে হাঁটে, তাহলে সামরিক, কূটনৈতিক ও নীতিগতভাবে তারা নিজের সঙ্গেই দ্বন্দ্বে জড়াতে পারে।
এ যেন এক অভূতপূর্ব যুদ্ধ- যেখানে ট্রাম্প কল্পনায় দেখবেন শত্রু বাহিনীও মার্কিন পতাকা বহন করছে।
মন্তব্য করুন