নূর হোসেন মামুন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:৪৬ এএম
আপডেট : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:১১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

৯০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে এখন মাথায় হাত

চট্টগ্রামে ‘জমেনি’ গাঁইট কাপড়ের ব্যবসা
৯০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে এখন মাথায় হাত

শীত মৌসুমে চাহিদা বাড়ে গরম কাপড়ের। কম্বল, জ্যাকেট, সোয়েটার, ট্রাউজার, ব্লেজার এবং লং কোট থাকে মানুষের পছন্দের শীর্ষে। এসব কাপড় সংগ্রহে সাবলম্বী বা উচ্চবিত্তরা বড় বড় বিপণিবিতান, দোকান-মার্কেটে ছুটলেও দেশের সিংহভাগ অংশ নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের নজর থাকে পুটপাতের ভ্রাম্যমাণ দোকান কিংবা গাইডে। সারা দেশের এই বৃহৎ পরিমাণের পুরোনো কাপড়ের চাহিদা মেটানো হয় চট্টগ্রাম থেকে। জাপান, কোরিয়া, চীন ও তাইওয়ান থেকে মূলত এই কাপড় আমদানি করা হয়। বন্দর থেকে সরাসরি খালাস শেষে এসব কাপড় আসে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে। সেখান থেকেই পাঠানো হয় সারা দেশে। এ বছর আমদানি করা হয়েছে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার গাঁইট কাপড়। কিন্তু আশানুরূপ শীত না পড়ায় জমেনি বেচাবিক্রি—এমনটাই বলছেন ব্যবসায়ীরা। তারা মনে করছেন, শীত কম থাকার পাশাপাশি আর্থিক সংকটের কারণেও এবার প্রত্যাশা অনুযায়ী ব্যবসা হয়নি। যে কারণে এবার লোকসান হতে পারে অনেক বেশি।

বাংলাদেশ পুরাতন কাপড় আমদানিকারক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, ‘আগে সরকার পাঁচ হাজার আমদানিকারককে অনুমতি দিয়েছিল। এখন সেটা নেমেছে তিন হাজারে। আর শর্তে দেওয়া হয়েছে, সর্বোচ্চ ১৪ টন আর ৫০ হাজার টাকার বেশি কাপড় আমদানি করা যাবে না। এরপরও এ বছর গত বছরের তুলনায় অর্ধকোটি টাকার বেশি পুরোনো কাপড় আমদানি হয়েছে। তবে আমদানির তুলনায় বিক্রি নেই।’

বাংলাদেশ পুরোনো কাপড় আমদানিকারক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনজুর আলম বলেন, ‘কিছুদিন সারা দেশে ব্যাপক শীত পড়ায় পুরোনো কাপড়ের চাহিদা কয়েক গুণ বেড়েছিল। তবে এখন শীতের মাত্রা কমে যাওয়ায় সেই চাহিদা আর নেই। এ বছর এলসি খোলার জটিলতা ছিল। ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে আমদানিকারকরা আশানুরূপ পুরোনো কাপড় আমদানি করতে পারেননি।’

সরেজমিন দেখা যায়, সড়কের পাশে পাতা চৌকিতে শীতের কাপড়ের স্তূপ। বেছে বেছে রংচটা পুরোনো কাপড় থেকে অপেক্ষাকৃত নতুন কাপড় কিনছেন অনেকে। একজন ক্রেতা ১৫০ থেকে ২৫০ টাকায় পেয়ে যাচ্ছেন পছন্দের সোয়েটার, কোট, গেঞ্জি ইত্যাদি। নগরীর এই জলসা মার্কেট ও হকার্স মার্কেটকে খুচরা কাপড় বিক্রির ‘গাঁইট মার্কেট’ হিসেবেই চিনেন স্থানীয়রা। মূলত এখানে এসব কাপড় আসে চট্টগ্রামে খাতুনগঞ্জ থেকে। সেখানে রয়েছে শতাধিক পুরোনো কাপড়ের পাইকারি দোকান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে নিলামে কেনা পুরোনো কাপড় চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে আসে খাতুনগঞ্জের কয়েকটি মার্কেটে। এই কাপড়ের আমদানিকারক আছেন প্রায় ৫০ জন। এই ব্যবসার সঙ্গে সারা দেশে প্রায় ১০ লাখ পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা জড়িত। খাতুনগঞ্জের আমির মার্কেটে প্রতি বেল সোয়েটার বিক্রি হচ্ছে ৮ থেকে ১১ হাজার টাকায়। প্রতি বেল জ্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে ১৬ হাজার টাকা, আর গেঞ্জির বেল ৭-৮ হাজার টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাধারণত এসব কাপড় জাপান, কোরিয়া ও তাইওয়ান থেকে আনা হয়। উন্নত দেশে ধোয়ার খরচ বেশি হওয়ায় অনেক সময় কাপড় দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা হয় না। সেখানকার ব্যবসায়ীরা ব্যবহৃত কাপড় কিনে, অনুন্নত দেশগুলোতে বিক্রি করেন বেল হিসেবে। আর পাইকারিতে এসব কাপড় বিক্রি হয় কেজি দরে। আর সেগুলোই বাংলাদেশে আমদানি করা হয়। তবে কাপড়গুলো দেখতে ফ্রেশ এবং ভালো মানের। সে হিসেবে কাপড়গুলোর দাম তুলনামূলকভাবে কম। শীতের কাপড়গুলোকে বাক্স আকারের প্যাকে ভর্তি করা হয়। যাকে বলা হয় ‘বেল’। আর এই ‘বেলই’ স্থানীয়দের কাছে ‘গাঁইট’ নামে পরিচিত।

খাতুনগঞ্জ আমির মার্কেটের মেসার্স ফারুক অ্যান্ড ব্রাদার্সের মালিক কাজী জাকির হোসেন আনিছ জানান, সব অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা কাপড় কিনতে আসেন। কেউ আসতে না পারলে মোবাইলে অর্ডার দেন। রাস্তাঘাট ভালো হওয়ায় পণ্য পরিবহনে সুবিধা হয়েছে।

খাতুনগঞ্জের পুরাতন পোশাকের আড়ৎদার মেসার্স হাসেম অ্যান্ড ব্রাদাসের্র নূর উদ্দিন বলেন, ‘আমরা কুরিয়ারের মাধ্যমে সারা দেশে বিক্রি করি। সারা দেশের খুচরা বিক্রেতারা আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যান। এখানে বেলপ্রতি ৫ থেকে ১২ হাজার টাকা দামের মধ্যে গাঁইট পাওয়া যায়। আমরা জ্যাকেট, সুয়েটার, গেঞ্জি, টি-শার্ট, জিন্সসহ সব ধরনের শীতের পোশাক রেখেছি। আমরা দ্বিতীয় পার্টি। প্রথম পার্টি থেকে প্রতি বেলে ২ থেকে ৩শ টাকা লাভে বিক্রি করি।’

জানা যায়, মূলত যেসব অঞ্চলে শীত বেশি বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য এসব পণ্য কিনে নিয়ে যান সেখানকার ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া সারা দেশ থেকেই ক্রেতারা এখানে আসেন। কারণ, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরাই মূলত পুরোনো কাপড় আমদানি করেন। এ ব্যবসায় আগ্রহী হলে থাকতে হবে আমদানির লাইসেন্স। সারা দেশে কোটা হিসেবে ৩ হাজার ব্যক্তিকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। প্রতি লাইসেন্সের বিপরীতে ৫০ হাজার টাকার বেশি পণ্য আমদানি করা যায় না।

আমির মার্কেটের পাইকারি দোকানের বিক্রেতা আবদুল হালিম জানান, আগে একটি লাইসেন্সে ৬ টন করে কাপড় আনা যেত। এখন তা ৩ টন করা হয়েছে, এতে সমস্যা হচ্ছে।

পুরোনো কাপড় আমদানিকারক সমিতির সূত্রে জানা যায়, এ বছর ৯০০ কোটি টাকার কাপড় আমদানি হয়েছে, যা গত বছর ছিল ৮৫০ কোটি টাকা। ওই হিসেবে আমদানি বেড়েছে ৫০ কোটি টাকার। তবে চট্টগ্রাম বন্দরে জানুয়ারি পর্যন্ত আমদানির তথ্যে দেখা যায়, এবার জাপান, তাইওয়ান, কোরিয়া, চীন থেকে ৭০২ টিইইউএস (২০ ফুট দৈর্ঘ্যের একক কনটেইনার) পুরোনো কাপড় আমদানি হয়েছে। এতে প্রায় ১২ হাজার টন কাপড় ছিল। আরও সাড়ে চার টন কাপড় ফেব্রুয়ারির মধ্যে আমদানি করার জন্য অনুমতি নেওয়া হয়েছে।

খাতুনগঞ্জের আমির মার্কেটের মেসার্স ফারুক অ্যান্ড ব্রাদার্সের মালিক আহমদ নূর খান বলেন, ‘নভেম্বর থেকে এসব পুরোনো কাপড়ের বেল বিক্রি জমে ওঠার কথা। অথচ জানুয়ারি মাস শেষ করে এখন ফেব্রুয়ারি। এখনো আশানুরূপ ক্রেতার দেখা নেই। গত বছর প্রতিদিন ৪০-৪৫টি বেল বিক্রি হলেও এ বছর সেটা ১৫-২০টিতে নেমেছে।’

চট্টগ্রামের জহুর হকার্স মার্কেটের ব্যবসায়ী আফজাল হোসেন বলেন, ‘চট্টগ্রামে শীত তেমন একটা নেই। শীত না থাকলেও আমরা নভেম্বর থেকে বেল সংগ্রহ করে ভালো মানের কাপড়গুলো দোকানে উঠিয়েছি। অল্পস্বল্প বিক্রি আছে। তবে গত বছরের তুলনায় বিক্রি নেই।’

নগরীর আগ্রাবাদ এলাকার ভাসমান হকার ফোরকান হোসেন বলেন, ‘আমরা কয়েকজন মিলে খাতুনগঞ্জের আমির মার্কেট থেকে বেলগুলো কিনি। এরপর সাইজ ও মানভেদে কাপড়গুলো বাছাই করে ভ্যানে বিক্রি করি। তবে এবার বিক্রি বেশি নেই। শীত বেশি পড়লে বিক্রি বাড়ে। কারণ, অধিকাংশ ক্রেতা নিম্ন আয়ের মানুষ। তারা শীত বাড়লে কেনে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অধ্যাদেশ নিয়ে ৬ হাজারের বেশি মতামত পেল মন্ত্রণালয়

ল্যাবএইডের কর্ণধার সাকিফ শামীমকে নিয়ে ফিচার করল ‘ইউএসএ টুডে’

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত

চাকসু নির্বাচন বর্জন এক প্যানেলের

খতমে নবুওয়তের মহাসম্মেলন সফল করতে মুন্সীগঞ্জে উলামায়ে কেরামের মতবিনিময় সভা 

সাংবাদিককে পুড়িয়ে হত্যার হুমকি শ্রমিক লীগ নেতার

ব্লকেড উঠিয়ে নতুন কর্মসূচির ঘোষণা শিক্ষকদের

ইউরোপের ৩ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে এনসিপির বৈঠক

হাসপাতালে লড়েও বাঁচলেন না ছুরিকাঘাতে আহত ছাত্রদল কর্মী

দুই যুবককে গুলি করে পালিয়ে গেল দুর্বৃত্তরা

১০

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাবেক এমপি বাদল রিমান্ডে 

১১

কেয়া হত্যা মামলা তুলতে হুমকি, তিনজনের বিরুদ্ধে আরেক মামলা

১২

৪০০ ব্যালটে স্বাক্ষর না থাকার অভিযোগ

১৩

স্পাউস ভিসার খপ্পরে অসংখ্য নারী, ভয়াবহ প্রতারণা 

১৪

চাকসুর ভোটগ্রহণ শেষ

১৫

মরুভূমিতে বালু ও পাথরচাপা অবস্থায় মিলল প্রবাসীর মরদেহ

১৬

রাকসু নির্বাচন : নিরাপত্তার চাদরে রাবি ক্যাম্পাস

১৭

কেনিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাইলা ওডিঙ্গা মারা গেছেন

১৮

গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় সংকট সৃষ্টি ‘কালো ঘোড়ার অনুপ্রবেশ’ ঘটাবে : রিজভী

১৯

বাংলাদেশ বিনির্মাণে ধানের শীষের বিকল্প নেই : আইনুল হক

২০
X