ডা. লেলিন চৌধুরী
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক। দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি ও ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা।
কালবেলা: বাংলাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে?
ডা. লেলিন চৌধুরী: ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে ২০১৯ সালে আর সবচেয়ে বেশি মৃত্যুবরণ করেছে ২০২২ সালে। এবার ডেঙ্গু যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে এবং আক্রান্তের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে আমাদের আশঙ্কা আগের সব রেকর্ড ভাঙবে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশই আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল। তাদের ক্ষেত্রে যেমন জটিলতা বেশি দেখা দেয়, তেমনি মৃত্যুর শঙ্কাও বেশি। এবারের ডেঙ্গুতে আমরা সেটিই লক্ষ্য করছি। দ্বিতীয়ত, ডেঙ্গুর ধরন, উপসর্গ ও লক্ষণ বদলে গেছে। আগে যেটি পাওয়া যেত, তীব্র জ্বর; শরীরে বিভিন্ন অংশে, মাংসপেশিতে, চোখের কোটরে পেছনের অংশে তীব্র ব্যথা। এবার আমরা বিপুলসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী পাচ্ছি যাদের জ্বর নেই, তবে পেট ব্যথা, বমি, পাতলা পায়খানা রয়েছে। অধিকাংশ রোগীর একেবারেই জ্বর নেই, শুধু ডায়রিয়ার লক্ষণ নিয়ে আসছেন। তৃতীয়ত, এবার ডেঙ্গুর শক সিনড্রোম বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে, যেটি আগে কম দেখা যেত। মৃত্যুর ক্ষেত্রেও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এবার শিশু ও ৪০ বছরের তরুণদের মৃত্যুর হার বেশি। অন্যদিকে মশার চরিত্রে বদল ঘটেছে। আগে যেমন এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ত, এখন ময়লা পানিতেও ডিম পাড়ছে এবং বংশ বিস্তার ঘটাচ্ছে। মশার কামড়েও পরিবর্তন এসেছে। আগে যেমন সকালে ও সন্ধ্যায় এডিস মশা কামড়াত, এখন সারা রাত, সারা দিনও কামড়াচ্ছে। ঢাকায় মশার হার অনেক বেড়ে গেছে। ডেঙ্গু এখন গ্রামপর্যায়েও ছড়িয়ে পড়েছে, যা খুবই মারাত্মক একটি খবর। মশা নিধনে সরকারের কর্মসূচিতে ন্যূনতম কোনো ইতিবাচক ফল দেখছি না। ফলে মানুষকে কামড়ানো অব্যাহত গতিতে চলছে।
কালবেলা: আমরা ডেঙ্গু সংক্রমণের কোন স্তরে রয়েছি?
ডা. লেলিন চৌধুরী: বাংলাদেশে ডেঙ্গু সংক্রমণের পিক পিরিয়ড হলো জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর। এবার জুলাই মাসের প্রথম তিন সপ্তাহে আমরা যে ধরনের এবং যে পরিমাণে ডেঙ্গু রোগী এবং মৃত্যু দেখছি তাতে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ গতি অব্যাহত থাকলে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বাড়বে। জুলাই ২৫ তারিখের মধ্যে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা হলো ২০১, এটি সরকারি হিসাব। ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যু ছিল ২৮০-এর মতো। এ গতিতে চলতে থাকলে আগামী দুই মাসে মৃত্যু ৬০০ ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এরই মধ্যে রাজধানীর সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের অধিকাংশেই কোনো শয্যা খালি নেই। ফলে ডেঙ্গু রোগীকে ভর্তি করানো যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে মশা নিধন, ডেঙ্গুর চিকিৎসা ও ডেঙ্গু ভাইরাসের চরিত্র নির্ধারণের ক্ষেত্রে গবেষণাধর্মী কাজ সফলভাবে করতে না পারলে আমার শঙ্কা হয় এবারে বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যাবে।
কালবেলা: মশা নিধনে সরকারের কার্যক্রমকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ডা. লেলিন চৌধুরী: আমরা বলি যখন কোনো বস্তুর ওপরে বল প্রয়োগ করলে বস্তুটির অবস্থানের পরিবর্তন হয় তখন তাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় কাজ করা। মশা নিধন ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য যে অভিযান ও কর্মকৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে সেক্ষেত্রে মশা নির্মূল না হলেও যদি নিয়ন্ত্রণ হতো বা মশার সংখ্যা কমে আসত তাহলে আমরা বলতাম মশা মারার জন্য কাজ করা হয়েছে। কিন্তু মশা যা ছিল তাই রয়েছে বা ক্ষেত্রে বিশেষে আরও বেড়েছে তাহলে আমরা বলব—মশা নিয়ন্ত্রণে সরকারের সব কাজ অসফল। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রও বলছেন, তিনি বুঝতে পারছেন না কেন মশা মরছে না। মশা মারার জন্য যে কার্যকর পদ্ধতি—জনস্বাস্থ্যের প্রধান যে কৌশল সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করা, সেটি গ্রহণ করা হয়নি। ওষুধ প্রয়োগ করে মশা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি পরিবেশগত ও জৈব নিয়ন্ত্রণ এবং জেনেটিক নিয়ন্ত্রণ—এগুলোর কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়নি। ফলে মশা মশার জায়গায়ই রয়ে গেছে, ডেঙ্গু বাড়ছে।
কালবেলা: বিশ্বে ডেঙ্গুর কয়েকটি টিকা নিয়ে আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে কয়েকটি দেশ টিকা চালুও করেছে। এসব টিকা বাংলাদেশে চালুর সম্ভাবনা কতটা?
ডা. লেলিন চৌধুরী: এরই মধ্যে ডেঙ্গুর বেশকিছু সফল টিকা বিশ্বে এসেছে। বিশেষ করে ২০২২ সালে জাপানের টাকেদা (Takeda) ফার্মাসিউটিক্যাল ডেঙ্গুর টিকা ‘কিউডেঙ্গা’ (Qdenga) আবিষ্কারের ঘোষণা দেয়। এটি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। কিউডেঙ্গা ডেঙ্গুর লক্ষণ প্রতিরোধ করে ৮০ দশমিক ২০ শতাংশ এবং হাসপাতালে ভর্তি প্রতিরোধ করে ৯০ শতাংশ ৪ শতাংশ। এরই মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, আইসল্যান্ড, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়াসহ আরও কিছু দেশ কিউডেঙ্গা ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার জনগণকে এরই মধ্যে এ টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। চার বছর বয়স থেকে এই টিকা দেওয়া যায়। তিন মাসের ব্যবধানে দুটি ডোজ শরীরের ত্বকের নিচে দিতে হয়। ইন্দোনেশিয়ায় ২ ডোজ টিকার দাম ৮০ ইউএস ডলার। কিউডেঙ্গা জীবনব্যাপী প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। এ টিকা ডেঙ্গুর সব ধরনের ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে।
এ ছাড়া ইউএসএর সানোফি-লুই পাস্তুর ইনকরপোরেশন ‘ডেঙ্গভ্যাকসিয়া’ নামের একটি টিকা বের করেছে। একবার ডেঙ্গু হওয়ার পরই কেবল এই টিকা নেওয়া যায়। প্রতি ডোজের দাম ১১৩ দশমিক ৭৫ ডলার। সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশে ডেঙ্গভ্যাকসিয়া অনুমোদিত। জাপানের টাকেদা ফার্মাসিউটিক্যাল ডেঙ্গুর টিকা ‘কিউডেঙ্গা’ সব ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে। এর জন্য পূর্বে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার দরকার হয় না। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও খুব কম।
ভারতের প্যানেসিয়া ফার্মাসিউটিক্যাল ও সেরাম ইনস্টিটিউট যৌথভাবে একটি টিকা নিয়ে কাজ করছে। এটি তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের শেষ ধাপে রয়েছে। এখন পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোনো টিকাকে অনুমোদন দেয়নি। তবে ইন্দোনেশিয়ার অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে বাংলাদেশে কিউডেঙ্গা টিকা ব্যবহার করা যেতে পারে।
সব মিলিয়ে আমাদের ভাবা উচিত। আমাদের সিটি করপোরেশন পৌরসভা মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে ফলে ডেঙ্গু বাড়ছে, মৃত্যু বাড়ছে , হাসপাতালগুলো রোগীর চাপে উপচে পড়েছে এবং লাখ লাখ শ্রমঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, অর্থনৈতিক উন্নতি ব্যাহত হচ্ছে। এক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়ার অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় এনে জাপানের টাকেদা ফার্মাসিউটিক্যালের তৈরি ডেঙ্গুর টিকা ‘কিউডেঙ্গা’ বাংলাদেশে ব্যবহার করা যায় কি না, সে ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তা করা উচিত।
কালবেলা: ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কলকাতা সফল ঢাকা কেন ব্যর্থ হলো?
ডা. লেলিন চৌধুরী: একটি কাজকে সফল করার জন্য যথাযথ বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা করতে হয়। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সব ধরনের উদ্যোগ নিতে হয়। সেই উদ্যোগের সঙ্গে জনসাধারণের সম্পৃক্ত হতে হয়। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের জন্য শতভাগ আন্তরিক থাকতে হয়। আমরা সম্ভবত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পূর্বশর্তগুলো পূরণ করতে পারিনি, তাই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছি।
মন্তব্য করুন