বিদায় ২০২৪, আজ শেষ দিন। আর কয়েক ঘণ্টা পরই মহাকালের আবর্তে বিলীন হতে যাচ্ছে আরও একটি বছর। রাত পোহালেই পূর্ব দিগন্তে উঁকি দেবে নতুন সূর্য। যাত্রা শুরু হবে নতুন বছরের। ২০২৪ সাল নানা কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ বছর আমাদের জাতীয় জীবনে ঘটেছে বেশ কয়েকটি অতিনাটকীয় ঘটনা। এর একটি হলো ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন। একটি রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানকে পেছনে ফেলে গত ৫ আগস্ট তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন। রাজপথে এখনো রক্তের দাগ শুকায়নি। বাতাসে এখনো বারুদের গন্ধ। মানুষের মনোজগতে এখনো ভেসে বেড়াচ্ছে স্বৈরাচারী হাসিনার বুলেটকে স্বাগত জানাতে বুক চিতিয়ে দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকা আবু সাঈদের প্রতিবাদী মুখ। রাস্তায় কান পাতলেই এখনো শোনা যায় শহীদ মুগ্ধর পানি বিতরণের অস্পষ্ট আওয়াজ। এখনো হাওয়ায় মিলে যায়নি দেড় সহস্রাধিক শহীদের স্বজনদের দীর্ঘশ্বাস। তাদের আর্তনাদ আর আহাজারিতে বারবার কেঁপে উঠছে আল্লাহর আরশ। পুলিশের গুলিতে হাত-পা, চোখ হারিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী অগণিত বীর যোদ্ধা দুর্বিষহ দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিনযাপন করছেন। আয়নাঘরে পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হতভাগ্যদের ঘোর এখনো কাটেনি। গুম হয়ে যাওয়া সন্তানরা ফিরবে বলে মায়েরা এখনো পথ চেয়ে আছেন। শহরের ব্যস্ত রাস্তায় অগণিত মানুষ পথচলতি অজানা-অচেনা লোকের দিকে নির্বিকার তাকিয়ে থাকে তাদের গুম হয়ে যাওয়া স্বজনের খোঁজে। শহরের দেয়ালে পাল্টে যাওয়া গ্রাফিতিগুলো এখনো মুক্তিকামী মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকে।
সময় সত্যিই এক নিষ্ঠুর খেলোয়াড়। এ বছরের শুরুতে একটি একতরফা ‘ডামি’ নির্বাচনে বিজয়ের পর আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মী ও সমর্থক ভেবেছিলেন, রাজনীতির মাঠে তাদের কোনো শক্ত প্রতিপক্ষ নেই। তারাই হলেন রাজনীতির মাঠের একাধিপতি। আগামী পাঁচ বছরের জন্য তারা নিশ্চিন্ত। তাই দলের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন অতিউৎসাহী নেতা অনাহূত ‘খেলা হবে’ বলে দম্ভভরে অবিরাম চিৎকার করেছিলেন। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য এবং হেয়প্রতিপন্ন করছিলেন দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি নেতাদের। কিন্তু বছরের মাঝামাঝি ভরা বর্ষায় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠতে পারে, এটা তাদের বোধের মধ্যেই ছিল না। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ভয়াবহ দুঃসময়ের মুখোমুখি হয় আওয়ামী ফ্যাসিবাদ। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা তার দীর্ঘ শাসনামলে গণমাধ্যমসহ সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করলেও তারুণ্যকে তিনি হত্যা করতে পারেননি। লোকচক্ষুর অন্তরালে বেড়ে ওঠে ফ্যাসিবাদ বধের নায়করা। দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তারুণ্য ক্রমান্বয়ে জেগে ওঠে এক ভয়ানক শ্বাপদ হয়ে। দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে ওরা দলে দলে আসে।
আন্দোলনের মুখে নির্বাহী আদেশে ২০১৮ সালে সরকারি চাকরি থেকে কোটা প্রথা বিলুপ্ত করেন সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একটি সংগঠনের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে এ বছর গত ৬ জুন হাইকোর্ট আবারও কোটা বহাল করে রায় দেন। এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। পরদিন ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের ব্যানারে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংগঠিত হতে থাকেন তারা। এ ব্যাপারে সরকারপ্রধানের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে দেওয়া বক্তব্য, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও ছাত্রলীগের হুমকি আন্দোলনে গতি সঞ্চার করে। আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতি-পুতি হিসেবে ইঙ্গিত করায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। অভিমানে নিজেদের রাজাকার আখ্যা দিয়ে তারা স্লোগান দেন সারা দেশের ক্যাম্পাসে। অবস্থা বেগতিক দেখে ছাত্রলীগ, পুলিশ ও বহিরাগত হেলমেট বাহিনীর সহযোগিতায় বেদম পেটায় আন্দোলনকারীদের। এক পর্যায়ে রংপুরে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। এ দৃশ্য লাইভে দেখে হতভম্ব হয়ে যায় পুরো জাতি। ছড়িয়ে পড়ে ক্ষোভের আগুন সবখানে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দমনপীড়নও বেড়ে যায় কয়েকগুণ। সমন্বয়কদের কয়েকজনকে গুম এবং পরে তুলে নিয়ে আটকে রাখা হয় ডিবি অফিসে। তাদের দিয়ে জোর করে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা পাঠ করান সমালোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ। এদিকে, আন্দোলনে যোগ দেন অভিভাবকের সঙ্গে, শিক্ষক, নানা শ্রেণির পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষ। ঢাকার আকাশে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হেলিকপ্টার মোতায়েন করা হয়। গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে মারা যায় ফুটফুটে শিশু, মেধাবী শিক্ষার্থী, নিম্ন আয়ের মানুষ, পথচারীসহ অনেকে। প্রতিদিন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় লাশ পড়তে থাকে। সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ, টিয়ার গ্যাসের শেল, বাতাসে বারুদের গন্ধে এক যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখা দেয় দেশে।
আন্দোলনকারীদের ডাকে একের পর এক অভিনব কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করতে থাকে কবি-শিল্পী-সাংস্কৃতিক কর্মীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন। বিএনপিসহ বেশিরভাগ বিরোধী রাজনৈতিক দল শুরু থেকে সহযোগিতা করে আসছিল। শুরুতে কোটা বাতিল চাইলেও আস্তে আস্তে ৪ এবং ৯ দফায় ওঠে আন্দোলন। এরই মধ্যে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় স্থাপনা ধ্বংস করে দুর্বৃত্তরা। প্রধানমন্ত্রী সেসব পরিদর্শনে গিয়ে সম্পদের জন্য কান্নাকাটি করেন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেন। কারফিউ জারি করার মধ্য দিয়ে সরকার নিজের কফিনে নিজেই শেষ পেরেক ঠুকে দেয়। শিক্ষার্থীদের দাবি মানা হবে বললেও, তাদের ওপর হামলা-মামলা-গ্রেপ্তার চলতেই থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করলেও, আন্দোলন দমনে সরকারের ব্যর্থতা প্রকাশিত হতে থাকে। দিন দিন দানা বেঁধে ওঠে গণঅভ্যুত্থানের ডাক। অনেক দেরিতে টনক নড়ে সরকারের। আলোচনার প্রস্তাব দেন সরকারপ্রধান; কিন্তু আন্দোলনকারীরা সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিকেলে আন্দোলনকারীদের ডাকে সর্বস্তরের মানুষ জড়ো হলে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। স্বতঃস্ফূর্ত এক অভ্যুত্থান থেকে সমন্বয়করা ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়ে এক দফা ঘোষণা করেন। হাজারও জনতা সমস্বরে প্রধানমন্ত্রীর পতদ্যাগের দাবিকে সমর্থন করেন এক আঙুল দেখিয়ে। পরদিন ঢাকাসহ সারা দেশে আওয়ামী লীগ প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এ দিন সারা দেশে ১৪ পুলিশ, শিক্ষার্থী, আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতাকর্মীসহ শতাধিক মানুষ প্রাণ হারান। সমন্বয়করাও চাইছিলেন আন্দোলনকে দ্রুত পূর্ণতা দিতে। তাই, পূর্বঘোষিত কর্মসূচি এক দিন এগিয়ে আনেন। ৫ আগস্ট ঠিক হয় ‘মার্চ টু ঢাকা’। ওদিকে, তিন বাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। বারবার ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করেও গুজব আটকাতে ব্যর্থ হয় সরকার। শেষ মুহূর্তে জনগণ মুক্তির আভাস পেলেও বুঝতে পারেনি আওয়ামী লীগ। ৪ আগস্টও আন্দোলনকারীদের জঙ্গি, বিএনপি-জামায়াত, সন্ত্রাসী উল্লেখ করে হামলা অব্যাহত রেখেছে।
রাতভর নানা গুঞ্জনের পর পাঁচ আগস্ট সকালে অবশেষে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। তার দেশত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গণভবন গণলুট হয় যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিল আক্রমণের স্টাইলে।
এর আগে আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি ক্যু এবং পাল্টা ক্যুর ঘটনা ঘটেছে। সেনা অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। গণঅভ্যুত্থানে সামরিক স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন; কিন্তু দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে।
শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বাহিনী আত্মগোপন করে। কেননা ফ্যাসিস্ট হাসিনা পুলিশ বাহিনীকে তার একটি প্রাইভেট বাহিনীর মতো ব্যবহার করতেন। দেশকে তিনি একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। ফলে তার পতনের পর পুলিশ বাহিনীকে আত্মগোপনে যাওয়া ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। অভ্যুত্থানের পর কোনো পুলিশ বাহিনীর আত্মগোপনের ঘটনা আধুনিক বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। পুলিশের অনুপস্থিতিতে ছাত্রছাত্রীরা দিনরাত সড়ক-মহাসড়কের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ডাকাত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখে। তারা দিন-রাত পালাক্রমে নিজ নিজ এলাকায় পাহারা দেয়। ৫ থেকে ৮ আগস্ট—এ কদিন দেশে কোনো সরকার ছিল না। তবুও দেশে বড় ধরনের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের ঘটনাকে এ বছর বিশ্বের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছে বিশ্বখ্যাত গণমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্ট। এ ঘটনার ভিত্তিতে পত্রিকাটি আমাদের প্রিয় জন্মভূমিকে ‘কান্ট্রি অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে নির্বাচিত করেছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণেই আমাদের এ স্বীকৃতি। ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘শেখ হাসিনার শাসনামলে ভোট ডাকাতি, বিরোধীদের কারাগারে পাঠানো ও বিক্ষোভকারীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর গুলি চালানো হয়েছে। শেখ হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতায় বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।’ ইকোনমিস্ট কর্তৃক ‘কান্ট্রি অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান একদিকে যেমন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে, তেমনি শাসক হিসেবে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা আধুনিক বিশ্বের নৃশংস ফ্যাসিস্ট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।
এদিকে, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট নিয়ে দেশে গঠিত হয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিএনপি, জামায়াতসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল নতুন সরকারের প্রতি সমর্থন জানায়। পতিত আওয়ামী লীগ, ১৪ দল ও জাতীয় পার্টি পড়ে জনরোষে। তবে, সহযোগিতা অব্যাহত রাখলেও গত পাঁচ মাসে সংস্কার, নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব বাড়ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাম্প্রতিক কার্যক্রমে জাতীয় রাজনীতির মেরূকরণ স্পষ্ট হচ্ছে। অভ্যুত্থানের পাঁচ মাস পর বিপ্লবের ঘোষণাপত্র নিয়েও রাজনীতিতে তৈরি হয়েছে নতুন কৌতূহল। ক্যালেন্ডারের পাতায় বছর শেষ হলেও পঁচিশজুড়ে চব্বিশের রেশ থাকবে বলেই মনে হচ্ছে।