দেশের অন্যতম বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়। মিরপুর ১নং সেকশনের মাজার রোডে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস। ৫ বছরের অস্থায়ী সনদ দিয়ে এর যাত্রা শুরু ২০০২ সালে। এরপর দীর্ঘ ২১ বছর পার হতে চললেও স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় এখনো স্থায়ী সনদ পায়নি প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে রয়েছে ফান্ড ঘাটতির অজুহাতে ৭ বছর ধরে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বেতন না বাড়ানো, বকেয়া বেতন পরিশোধ ও র্যাগিংয়ের বিচারে অনীহার অভিযোগ। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়টির বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, করোনা বা এর পরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কড়ায় গন্ডায় শতভাগ টিউশন ফি আদায় করা হয়েছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী, প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রথমে ৭ বছর মেয়াদের সাময়িক অনুমতি নিতে হবে। এর মধ্যে স্থায়ী সনদের জন্য আবেদন করতে হবে। স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার ক্ষেত্রে ন্যূনতম ১ একর জায়গা থাকতে হবে। আর অন্য এলাকায় হলে ৩ একর জমি থাকতে হবে। স্থায়ী সনদের আবেদন করার আগে শর্ত পূরণ করতে অক্ষম হলে পুনরায় সাময়িক অনুমতির জন্য আবেদন করতে হবে।
আজ পর্যন্ত স্থায়ী ক্যাম্পাসের শর্ত পূরণ না করতে পারা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক আশরাফ আলী বলেন, এ বিষয়ে আমাদের ডিল (চুক্তি) হবে সরকারের (ইউজিসি) সঙ্গে। আপনি এ বিষয়ে জানতে চাইছেন কেন? আমাদের কিছু বলার থাকলে সরকারকেই বলব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য তাদের এক একর জায়গা নেই, কিছু জায়গা কম আছে। সে কারণে স্থায়ী সনদের আবেদন করেও লাভ হচ্ছে না। সেজন্য আশপাশে জমি খোঁজা হচ্ছে। কিনে বা সরকার থেকে লিজ নিয়ে হলেও এক একর পূর্ণ করব। তিনি আরও বলেন, যদি এখানে না পাই, প্রয়োজনে মিরপুর বেড়িবাঁধের দিকে জমি নেব। ইতোমধ্যে সেখানেও আমাদের জমি খোঁজার কাজ চলছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের দায়িত্বে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ কালবেলাকে বলেন, প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ একর থেকে ৪২ শতাংশ জায়গা কম আছে। সে কারণে তারা এখনো স্থায়ী সনদ পায়নি। এ বিষয়ে তাদের কাছে কারণ জানতে চাওয়া হয়েছিল। তারা জানিয়েছে, মিরপুরে তাদের ক্যাম্পাসের পাশে ৪২ শতাংশ জায়গা নেওয়ার চেষ্টা চলছে। সেটি সত্য হলে তাদের আরও কিছু সময় দেওয়া যায়।
৪ কোটি টাকা বেতন বকেয়া : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কম। তারপরও করোনাকালীন বেতন বকেয়া রেখেছে কর্তৃপক্ষ। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাসের প্রথম সপ্তাহে বেতন হলেও এখানে হয় ১৫ তারিখের পরে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এখনো প্রায় ৪ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এসব টাকা চাওয়া হলে বলা হয়, ফান্ডে টাকা নেই। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রাটেজিক্যাল ভুল ছিল। শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বকেয়া টাকা না দিয়ে ৬০-৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ তলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। সেই ভবনের সব কাজও শেষ হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ক্যাপ্টেন এম এ জব্বার বলেন, আমরা এই বছরের বাজেটে বরাদ্দ রেখেছি। চেষ্টা করছি আস্তে আস্তে পরিশোধ করার। আর্থিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান হবে।
তবে এ বিষয়ে সাক্ষাৎ করেও ট্রাস্টি বোর্ডের কারও মন্তব্য পাওয়া যায়নি। লিখিতভাবে প্রশ্ন না দিলে তথ্য দেবেন না বলে জানান তারা।
৭ বছর ধরে বাড়ে না বেতন : প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক ও কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৭ বছর ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতন বাড়ানো হচ্ছে না। ইনক্রিমেন্ট দাবি করলে বিভিন্ন অজুহাতে এড়িয়ে যাওয়া হয়। তবে এমএলএসএস তথা কর্মচারী, যাদের বেতন কম তাদের ইনক্রিমেন্ট সম্প্রতি দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক জানান, ইনক্রিমেন্ট কাগজে-কলমে হয়েছে। তবে শিক্ষকরা এখনো পাননি। ইনক্রিমেন্ট দেবে দেবে বলে সাত-আট মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বলেন, শিক্ষকদের ইনক্রিমেন্ট বিওটিতে (ট্রাস্টি বোর্ডে) পাস হয়ে গেছে। আমরা দ্রুত সেটি বাড়াব।
নেই র্যাগিংয়ের বিচার : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধে সম্প্রতি নীতিমালা জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষক, কর্মচারী, শিক্ষার্থী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে র্যাগিং ও বুলিংয়ে জড়িত থাকলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাদের শাস্তি হবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ফৌজদারি আইনে র্যাগিংয়ে জড়িত শিক্ষক, শিক্ষার্থী বা সভাপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
তবে প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র বলছে, আইন বিভাগের শিক্ষার্থীরা এতে বেশি জড়িত। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা সিসিটিভির আওতায় থাকায় লিফটে জুনিয়রদের র্যাগ দেয় সিনিয়ররা। তবে র্যাগিংয়ের শিকার শিক্ষার্থীরা সিনিয়রদের বিরুদ্ধে বিচার দিলেও এতে কোনো লাভ হয় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী প্রক্টর কালবেলাকে বলেন, অধিকাংশ সময় লিফটে জুনিয়ররা র্যাগিংয়ের শিকার হয়, যা সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ে না। কোনো শিক্ষার্থী প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিলে কমিটি গঠন হয়। এরপর আলোচনার টেবিলেই সমঝোতার মাধ্যমে অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কমিটি প্রতিবেদন দিলেও ট্রাস্টিদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মীমাংসা হয়।
তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান, সাধারণ সম্পাদকসহ সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, আমরা কোনোভাবেই র্যাগিং বরদাশত করি না। আমাদের অ্যান্টি র্যাগিং কমিটি আছে। এ ছাড়া কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে কমিটি গঠন করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়।
সার্বিক বিষয়ে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেতন-ভাতা অনুযায়ী সংবিধি আছে কি না, সেটি দেখতে হবে। আমরা চাই, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারি স্কেল অনুযায়ী শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বেতন দেবে। কিন্তু বেতন না বাড়া দুঃখজনক। আমাদের তদন্তে যদি কোনো অনিয়ম ধরা পড়ে, তাহলে আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই র্যাগিং থাকা উচিত নয়। সব বিশ্ববিদ্যালয়ই র্যাগিং মুক্ত থাকবে, এটাই চাই।
মন্তব্য করুন