আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের
প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২৫, ০৯:২৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইউজিসিতে তারা সব আমলে সুবিধাভোগী

প্রশাসনিক জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘন
ইউজিসিতে তারা সব আমলে সুবিধাভোগী

আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) যেসব কর্মকর্তা নিয়োগ পেয়েছেন বা পদোন্নতি, লোভনীয় দপ্তরে পদায়নসহ বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করেছেন, তাদের অনেকেই সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নিজেদের ‘বঞ্চিত’ দাবি করে ফের পদোন্নতি নিয়েছেন। এমনকি কম্পিউটার অপারেটর বা তৃতীয় শ্রেণির অন্যান্য পদে কর্মচারী হিসেবে যোগ দিয়েও অনেকেই এখন তৃতীয় গ্রেডের কর্মকর্তা হয়ে গেছেন, যা ইউজিসির প্রবিধানমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

ইউজিসির একাধিক কর্মকর্তা এই পদোন্নয়নকে ‘প্রশাসনিক অরাজকতা’ বলে অভিহিত করেছেন। সংশ্লিষ্টদের মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বৈষম্যের শিকার হওয়ার অভিযোগ এনে নতুন প্রশাসনকে বিভ্রান্ত করে, উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে এবং চাপ প্রয়োগ করে অনেক কর্মকর্তা পদোন্নতি আদায় করেছেন। শুধু তাই নয়, তারা সাধারণ কর্মচারীদের ক্ষুব্ধ করে ইউজিসি সচিবের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করেছেন, ফলে প্রশাসনিক জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘনও হয়েছে।

পদোন্নতি বিতর্ক ও প্রশাসনিক জটিলতা: ইউজিসির অফিস আদেশ অনুযায়ী, গত বছরের ২৩ অক্টোবর ইউজিসি সচিব ড. মো. ফখরুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল পদোন্নতি-সংক্রান্ত বৈষম্য নিরূপণ। পরে ২৮ অক্টোবর কমিটি পুনর্গঠন করে অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেনকে আহ্বায়ক করা হয়। কিন্তু ৪ নভেম্বর আবারও কমিটি গঠন করে পূর্বের দুটি আদেশ বাতিল করা হয়। নতুন কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩৩ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়।

এ কমিটির অন্যতম সদস্য মো. রেজাউল করিম হাওলাদার ২০১৯ সালে চাঁদাবাজির অভিযোগে বরখাস্ত হয়েছিলেন, যদিও পরে তার শাস্তি প্রত্যাহার করা হয়। অন্যদিকে ইউজিসি সচিব গত ১৬ বছরে একাধিক পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে সচিব পদে আসীন হয়েছেন। তিনি গণআন্দোলনের সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্কিত মন্তব্য করেও সমালোচিত হয়েছেন।

প্রবিধান লঙ্ঘন করে পদোন্নতি: ইউজিসির প্রবিধানের ১৯ (১) ধারা অনুযায়ী, কমিশনের সব পদ সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করার কথা। ১৯ (২) ধারা অনুসারে, প্রথম শ্রেণির পদ ব্যতীত, অন্যান্য শ্রেণির সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পদ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সরাসরি নিয়োগের পরিবর্তে অবৈধভাবে পদোন্নতির মাধ্যমে অনেক পদ পূরণ করা হয়েছে। ফলে তৃতীয় শ্রেণির কম্পিউটার অপারেটরদের অনেকে এখন অতিরিক্ত পরিচালক বা উপপরিচালক পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।

কে কীভাবে পদোন্নতি পেলেন: ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, মামুনুর রশীদ খান, হারুন মিয়া, মোয়াজ্জেম হোসেন সরকার এবং মামুন পাটওয়ারী তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে কমিশনে যোগ দেন। ২০০৯ সালে তিনজন কম্পিউটার অপারেটর এবং হারুন সিনিয়র ক্যাটালগার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৩ সালে তাদের প্রথম শ্রেণির প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়, ২০১৮ সালে তারা সহকারী পরিচালক হন এবং সাম্প্রতিক পদোন্নতিতে তারা সিনিয়র সহকারী পরিচালক হয়েছেন।

এদিকে, নিয়মবহির্ভূতভাবে ২০০৩ সালে ৩৩ বছর বয়সে অ্যাডহক ভিত্তিতে কম্পিউটার অপারেটর পদে যোগ দেওয়া সুরাইয়া ফারহানা বর্তমানে অতিরিক্ত পরিচালক হয়েছেন, যদিও সে সময় সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ছিল ৩০ বছর।

২০০৮ সালের ২১ অক্টোবর এক আদেশে সুরাইয়া ফারহানা ও আরও ৩৪ জন কর্মকর্তার পদ তাদের যোগদানের তারিখ থেকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়, যা তাদের চাকরির পুরোনো সময়কেও প্রথম শ্রেণির চাকরি হিসেবে গণ্য করে।

জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন ও রাজনৈতিক প্রভাব: ইউজিসি নীতিমালা অনুযায়ী, অতিরিক্ত পরিচালক হতে হলে উপপরিচালক হিসেবে ন্যূনতম ৪ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। কিন্তু গোলাম মোস্তফার অভিজ্ঞতা মাত্র আড়াই বছর এবং আকরাম আলী খানের এক বছরেরও কম। তাদের পদোন্নতির ফলে অন্তত ৭ জন কর্মকর্তা জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন।

এদিকে, মাসুদ হোসেন ২০০৬ সালে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে ইউজিসিতে যোগ দেন এবং চাকরিরত অবস্থায় ছুটি না নিয়েই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণকালীন অনার্স কোর্স সম্পন্ন করেন, যা বিধি অনুযায়ী অবৈধ।

এ ছাড়াও, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের বর্তমান পরিচালক ড. মোহাম্মদ সুলতান মাহমুদ ভূঁইয়া, রিসার্চ গ্রান্টস অ্যান্ড অ্যাওয়ার্ড বিভাগের মোহাম্মদ কবিরুল হাসান, এবং জেনারেল সার্ভিসেস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিবানন্দ শীল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজের অভিজ্ঞতা দেখিয়ে ইউজিসির উচ্চপদে যোগ দেন, যা সরকারি নিয়োগ বিধির পরিপন্থি।

তৃতীয় শ্রেণি থেকে ঊর্ধ্বতন পদে পদোন্নতি: ২০১১ সালে কম্পিউটার অপারেটর পদে যোগ দেওয়া মোরশেদ আহম্মদ, নুর ইসলাম চৌধুরী, আকতার পেরিস এবং হাছিনা পারভীন ২০১৩ সালে প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ২০১৮ সালে সহকারী পরিচালক এবং বর্তমানে সিনিয়র সহকারী পরিচালক হয়েছেন।

এদিকে, ২০২০ সালে দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেওয়া ৮ জন সম্প্রতি সহকারী পরিচালক হয়েছেন, যার মধ্যে পারভেজ গাজী দাবি করেছেন, রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে তাদের পদোন্নতি প্রক্রিয়া সহজ হয়েছে।

উচ্চক্ষমতা-সম্পন্ন কমিটির তদন্ত: ইউজিসি সচিব ড. মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি এই পদোন্নতি পর্যবেক্ষণ করেছে এবং কমিশন যথাযথ নীতিমালা অনুসরণ করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে কেউ বঞ্চিত হলে, তাদের আবেদন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।’

ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, ‘পদোন্নতির ক্ষেত্রে কেউ অতিরিক্ত সুবিধা পেয়েছে কি না বা কেউ বঞ্চিত হয়েছে কি না, তা যাচাই করা হচ্ছে। এ ছাড়া, ইউজিসির প্রবিধানমালা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে এমন বিতর্কের অবকাশ না থাকে।’

তিনি আরও বলেন, ‘নিচু পদ থেকে কেউ পদোন্নতি পেয়ে উচ্চ পদে যেতে পারবে না, এমন বিধিনিষেধ থাকা উচিত নয়। তবে তা যোগ্যতার ভিত্তিতে হওয়া দরকার।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বাংলাদেশের ম্যাচসহ টিভিতে আজকের খেলা

গ্যাস লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ, একই পরিবারের দগ্ধ ৯

২৩ আগস্ট : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

স্কয়ার গ্রুপে আবেদনের সুযোগ, আর মাত্র একদিন বাকি

ঢাকা রিজেন্সি হোটেলে চাকরির সুযোগ, আবেদন করুন আজই

গাজায় দুর্ভিক্ষ শুরু, কড়া প্রতিক্রিয়া সৌদির

৬০ কিমি বেগে ঝড়ের আভাস, নদীবন্দরে সতর্কসংকেত

আজ ঢাকায় আসছেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী, যেসব বিষয়ে আলোচনা

গাজায় ভয়াবহ হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল, আরও ৭১ নিহত

২৩ আগস্ট : আজকের নামাজের সময়সূচি

১০

ফেনসিডিল কাণ্ডে এসআই কামাল প্রত্যাহার

১১

শনিবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

১২

রাজধানীতে মধ্যরাতে ভয়াবহ আগুন

১৩

ভালোবেসে বিয়ে, ৫ মাসের মাথায় গৃহবধূর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার

১৪

বিচারককে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগে জামায়াত নেতাকে অব্যাহতি

১৫

২০১৮ সালের নির্বাচনের বদনাম ঘোচাতে চায় পুলিশ : ডিএমপি কমিশনার

১৬

ওয়েস্ট হ্যামের বিরুদ্ধে চেলসির বড় জয়

১৭

নরসিংদী জেলা সাংবাদিক সমিতি, ঢাকা’র নতুন কমিটিকে সংবর্ধনা

১৮

কেইনের হ্যাটট্রিকে লেইপজিগকে উড়িয়ে দিল বায়ার্ন

১৯

নিখোঁজের একদিন পর যুবকের মরদেহ মিলল পুকুরে

২০
X