ইউসুফ আরেফিন
প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২৩, ০২:২৮ এএম
আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০২৩, ০৮:১৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অর্জনের কৃষিতে নানা চ্যালেঞ্জ

কৃষি উপকরণের দাম বাড়ছে
অর্জনের কৃষিতে নানা চ্যালেঞ্জ

কৃষি উৎপাদনে গত দেড় দশকে বেশ সফলতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এই সময়ে দেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। ৩৭ শতাংশ বেড়েছে গমের উৎপাদন। ভুট্টার উৎপাদন প্রায় ৬৫ শতাংশ বেড়েছে। কৃষিতে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির কারণেই বৈশ্বিক মন্দায় শ্রীলঙ্কা কিংবা পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েনি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

ধারাবাহিক এই অর্জনের মধ্যেও কৃষি খাত নিয়ে দিন দিন বাড়ছে উদ্বেগ। কারণ, একদিকে কমছে আবাদি জমি, অন্যদিকে বাড়ছে কৃষি উপকরণের দাম। এ অবস্থায় বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে কৃষিজমি রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ, অনুৎপাদনশীল খাতে ভর্তুকি কমিয়ে কৃষিতে প্রণোদনা বৃদ্ধি এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মো. আনোয়ারুল হক বেগ কালবেলাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আছে কোনো জমি যেন অনাবাদি না থাকে। সেদিকে সংশ্লিষ্টদের মনোযোগ দিতে হবে। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। বৈদেশিক ঋণদাতা সংস্থাগুলো বিপরীত পরামর্শ দিলেও কৃষিতে ভর্তুকি আরও বাড়াতে হবে। গবাদি পশু ও মৎস্য খাতও ভর্তুকির আওতায় আনতে হবে। এ ছাড়া সময়মতো সার, কীটনাশক ও বীজ কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে হবে।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১১ দশমিক ২০। খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পর উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। ২০০৮-০৯ সালে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ২৮ লাখ ৯৬ হাজার মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে ৪ কোটি ৭৭ লাখ ৬৮ হাজার মেট্রিক টন হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য ফসলের উৎপাদনেও ধারাবাহিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে।

তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, গত ১৫ বছরে আলুর উৎপাদন বেড়েছে ২ গুণ, ডাল ৪ গুণ, তেলবীজ আড়াই গুণ ও সবজি ৮ গুণ। বাংলাদেশ ২২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে রয়েছে। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয়, সবজি ও পেঁয়াজ উৎপাদনে তৃতীয়, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, চা উৎপাদনে চতুর্থ এবং আলু ও আম উৎপাদনে সপ্তম।

জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন : গত দেড় দশকে বৈরী পরিবেশ সহনশীল জাতসহ মোট ৬৯৯টি উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ। ৭০৮ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ধানের ৮০টি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ৬১টি জাত উদ্ভাবন করেছে। লবণাক্ত সহনশীল ৯ জাতের ধান উদ্ভাবন করেছে ব্রি। জাতগুলো হলো— ব্রি ৫৩, ব্রি ৫৪, ব্রি ৫৫, ব্রি ৬১, ব্রি ৬৭, ব্রি ৭৩, ব্রি ৭৮, ব্রি ৯৭, ব্রি ৯৯। জলমগ্নতা ও জলাবদ্ধতা সহনশীল ৩টি (ব্রি ৫১, ব্রি ৫২, ব্রি ৭৯) জাত উদ্ভাবন করেছে ব্রি। খরা সহনশীল ব্রি ৫৬, ব্রি ৬৬, ব্রি ৭১ উদ্ভাবন করা হয়েছে। জোয়ার-ভাটা সহনশীল ২টি (ব্রি ৭৬, ব্রি ৭৭)। প্রিমিয়ার কোয়ালিটি ৭টি (ব্রি ৬৩, ব্রি ৭০, ব্রি ৭৫, ব্রি ৮০, ব্রি ৮১, ব্রি ৯০, ব্রি ১০৪)। জিঙ্ক সমৃদ্ধ ৭টি (ব্রি ৬২, ব্রি ৬৪, ব্রি ৭২, ব্রি ৭৪, ব্রি ৮৪, বঙ্গবন্ধু ধান ১০০, ব্রি ১০২) জাত রয়েছে ব্রি উদ্ভাবনের তালিকায়।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৯টি ধানের জাতসহ বিভিন্ন ফসলের ৮৬টি জাত উদ্ভাবন করেছে। জাতগুলো হচ্ছে—স্বল্প জীবনকালীন ধান, বিনাধান-১৬ ও বিনাধান-১৭, লবণসহিষ্ণু বোরো ধানের ২টি বিনাধান-৮ ও বিনাধান-১০ এবং জলমগ্নতা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু ধানের জাত বিনাধান-২৩। এ ছাড়া বিনা গম-১টি, তেল ফসল-২৩টি, ডাল ফসল-২৪টি ও টমেটোর ৮টি জাত উদ্ভাবন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই) গত ১৫ বছরে ২০৯টি ফসলের উচ্চ ফলনশীল ও প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু জাত, হাইব্রিডসহ ৩৪৭টি জাত এবং ৪০৩টি ফসল উৎপাদনের উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে।

বীজ সরবরাহ : ১৫ বছরে বিএডিসি সর্বমোট ২০ লাখ ৬৬ হাজার মেট্রিক টন বিভিন্ন ফসলের বীজ উৎপাদনের পর বিতরণ করেছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বীজ বিতরণের পরিমাণ ছিল ৯০ হাজার ৯২৮ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার মেট্রিক টনে। করোনার প্রতিঘাত মোকাবিলায় বীজের দাম ২৫ শতাংশ কমানো হয়েছে।

খামার যান্ত্রিকীকরণ: নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষিকে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কৃষকদের কৃষিযন্ত্রের ক্রয়মূল্যের ওপর হাওর ও উপকূলীয় এলাকায় ৭০ শতাংশ এবং অন্যান্য এলাকায় ৫০ শতাংশ উন্নয়ন সহায়তার মাধ্যমে কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হচ্ছে। কম্বাইন হারভেস্টর, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, রিপার, সিডার ও পাওয়ার থ্রেসারসহ প্রায় ১ লাখ ৩৩ হাজারটি কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে। এর ফলে কৃষি শ্রমিকের অপ্রতুলতা মোকাবিলা এবং উৎপাদন ব্যয় কমেছে বলে মনে করেন কৃষিবিজ্ঞানীরা।

কৃষিঋণ: প্রচলিত ব্যাংকিং চ্যানেলে সুবিধাবঞ্চিত বর্গাচাষিদের দোরগোড়ায় সময়মতো, স্বল্পসুদে জামানতবিহীন কৃষি ঋণ সুবিধা পৌঁছে দিতে সরকার ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থায়নে ‘বর্গাচাষিদের জন্য কৃষিঋণ’ কর্মসূচি গ্রহণ করে। প্রতিবছর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা’-এর আওতায় কৃষকদের ঋণ দেওয়া হয়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১৭ লাখ ২৯ হাজার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ৪ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৭ লাখ ৩৬ হাজার কৃষকের মধ্যে কৃষিঋণ বিতরণ করা হয় ২২ হাজার ৪০২ কোটি টাকা।

বন্যা, খরা, শিলাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, উজানের ঢল, পাহাড়ি ঢল ইত্যাদি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ও বিশেষ বিশেষ ফসল চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৯৩৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা প্রণোদনা দেয় সরকার। ফলে ২ কোটি ২৩ লাখ ২১ হাজার কৃষক উপকৃত হয়েছেন।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম কালবেলাকে বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিবছরই দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে। সব মিলিয়ে গত পাঁচ দশকে খাদ্য উৎপাদন চারগুণেরও বেশি বেড়েছে। তবে এখনো খাদ্যে পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়েছে—বলা যাবে না। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষকদের নগদ প্রণোদনা সহায়তা দিতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের কৃষির ওপরও পড়ছে। উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে আউশ ও আমনের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, ডিজেলের দাম বেড়েছে। এগুলো সেচের সঙ্গে জড়িত। ফলে সেচের খরচও বেড়েছে। এ ছাড়া সারের দামও বাড়ানো হয়েছে। এগুলো কৃষকের কাছে সহজলভ্য করতে হবে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

স্বপ্ন ছোঁয়ার আগেই থেমে গেল অরণ্যের জীবন

সন্তানকে বাঁচাতে মেট্রোরেলের গেট ধরে মায়ের আহাজারি

এবার নতুন কর্মসূচির ঘোষণা প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের

অভিনেত্রী মানেই পোশাক খুলে দাঁড়িয়ে পড়বে?

প্রীতির হ্যাটট্রিকে নেপালের বিপক্ষে আরেকটি জয় বাংলাদেশের

গ্রেপ্তার ডাকসুর ভিপি প্রার্থী জালালকে নিয়ে রাশেদের পোস্ট

রাজশাহীতে বিভাগীয় ভোক্তা অধিকার সম্মেলন অনুষ্ঠিত

কৃষি জমি রক্ষায় দ্রুত আইন আসছে : কৃষি উপদেষ্টা

টিসিবির চাল নিয়ে বাড়ি ফেরা হলো না বৃদ্ধের

সরকারি কর্মচারীদের চিকিৎসায় অনুদান মঞ্জুরির হার পুনর্নির্ধারণ

১০

প্রবল বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত হিমাচল প্রদেশ, ২৪৫০ কোটি টাকার ক্ষতি

১১

কবরের আজাব ও বার্ধক্যের দৈন্য থেকে মুক্তি পেতে যে দোয়া পড়বেন

১২

ডুবন্ত বাঁধ নির্মাণ হলে হাওরে কৃষি উৎপাদনের ক্ষতি কমানো সম্ভব : রিজওয়ানা হাসান

১৩

আমড়া ভর্তা খেয়ে হাসপাতালে ৬ শিক্ষার্থী

১৪

সিইসির সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বৈঠক বৃহস্পতিবার

১৫

‘কাজী জাফরকে বাদ দিয়ে কেউ বাংলার ইতিহাস লিখতে পারবে না’

১৬

গণঅভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থীদের তথ্য চেয়ে ‘জরুরি’ নির্দেশনা

১৭

পাঁচটি কংক্রিট মিক্সারসহ নিলামে ৫৮ লট পণ্য

১৮

নতুন আইফোন কবে আসছে, জানাল অ্যাপল

১৯

‎গকসু : শুরুতেই নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ

২০
X