বাকৃবি প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:২৪ এএম
আপডেট : ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ০১:১২ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

জাতিসংঘ ফেলোশিপে ১০ নারীর মধ্যে স্থান পেলেন বাকৃবির মারজানা

জাতিসংঘ ফেলোশিপে নারী গবেষক হিসেবে নির্বাচিত মারজানা আক্তার। ছবি : সংগৃহীত
জাতিসংঘ ফেলোশিপে নারী গবেষক হিসেবে নির্বাচিত মারজানা আক্তার। ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের প্রথম নারী গবেষক হিসেবে মারজানা আক্তার নির্বাচিত হয়েছেন জাতিসংঘের ইয়াং উইমেন ফর বায়োসিকিউরিটি ফেলোশিপ ২০২৫ প্রোগ্রামে। পৃথিবীর ১৯৩টি দেশের মধ্য থেকে মাত্র ১০ জন তরুণী গবেষক এই মর্যাদাপূর্ণ ফেলোশিপের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন এবং তাদের মধ্যে স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের এই মেধাবী গবেষক।

বিশ্বব্যাপী বায়োলজিক্যাল উইপনস কনভেনশনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ফেলোশিপের আয়োজন করছে জাতিসংঘের নিরস্ত্রীকরণ বিষয়ক দপ্তর। এর উদ্দেশ্য হলো—জীববিজ্ঞানের ব্যবহারকে মানবকল্যাণের পথে পরিচালিত করা এবং বায়োসিকিউরিটি বিষয়ে বৈশ্বিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

বিষয়টি সোমবার (৬ অক্টোবর) দুপুরে মারজানা আক্তার নিজেই নিশ্চিত করেছেন। এর আগে গত ১ অক্টোবর তাকে মেইলের মাধ্যমে ফেলোশিপের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয় বলে জানিয়েছেন তিনি।

এ বছরের ফেলোশিপের সমাপনী অনুষ্ঠান হবে ডিসেম্বর মাসে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়, যেখানে বিশ্বের শীর্ষ গবেষক ও নীতিনির্ধারকরা অংশ নেবেন। বাংলাদেশ থেকে মারজানা আক্তার সেখানে দেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন, যা বাংলাদেশের জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত হবে।

তবে এ সাফল্যের পেছনের গল্পটা শুধুই মেধার নয়। এটি ছিল অধ্যবসায়, সাহস আর ভালোবাসার গল্প। মারজানা সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইক্রোবায়োলজিতে স্নাতকোত্তর (এমএসসি) সম্পন্ন করেছেন। এর আগে তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (সাস্ট) থেকে বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকুলার বায়োলজিতে স্নাতক (বিএসসি) ডিগ্রি অর্জন করেন।

তার স্নাতকোত্তর গবেষণায় তিনি বাংলাদেশের পোলট্রিতে চিকেন ইনফেকশাস অ্যানিমিয়া ভাইরাস নিয়ে কাজ করে দেশের প্রথম জেনোটাইপ থ্রি-বি স্ট্রেইন শনাক্ত করেন, যা ভাইরোলজি গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। তার এই গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বাকৃবির মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. গোলজার হোসেন, যিনি পুরো যাত্রাতেই তাকে দিকনির্দেশনা ও উৎসাহ দিয়ে পাশে থেকেছেন।

তবে এ পথচলা সহজ ছিল না। স্নাতকোত্তর পড়াশোনার পুরো সময় তিনি ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। সকালে ক্লাস, বিকেলে ল্যাব, রাতে থিসিস লেখা—সবকিছুই তিনি করেছেন শারীরিক কষ্ট সহ্য করেও। গর্ভাবস্থার ষষ্ঠ মাসে তীব্র শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তাকে আইসিইউতে ভর্তি হতে হয় এবং সেখানে তিনি কাটান পাঁচটি ভয়াবহ দিন। সে সময় তার স্বামী ইউশা আরাফ নিউজিল্যান্ডে যান অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োমেডিকেল সায়েন্সে পিএইচডি করতে। একা, অসুস্থ ও মানসিক চাপে থেকেও মারজানা থেমে থাকেননি। এই কঠিন সময়েও তার পাশে ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক ড. গোলজার হোসেন। তিনি শুধু একাডেমিকভাবে নয়, মানবিকভাবেও তাকে সাহস জুগিয়েছেন এবং সব বাধা অতিক্রম করে গবেষণা চালিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন।

ঠিক সে সময়ে আসে সাকুরা সায়েন্স এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার সুযোগ, যা সম্পূর্ণ অর্থায়ন করে জাপান সরকার। ড. গোলজার হোসেনের নেতৃত্বে তার পুরো ল্যাব সেই প্রোগ্রামের জন্য নির্বাচিত হয় এবং পুরো টিম ওকায়ামা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুশিমা ক্যাম্পাসে গবেষণা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ে অংশ নেয়। কিন্তু ভাগ্য তখনো তাকে পরীক্ষা নিচ্ছিল, মারজানা ছিলেন আইসিইউতে, তাই সেই সফরে যেতে পারেননি।

তবুও তিনি হার মানেননি। কয়েক মাস পর জন্ম নেয় তার কন্যা আনাইজা, আর সন্তানের জন্মের মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরই তিনি অসুস্থ শরীর নিয়ে তার স্নাতকোত্তর থিসিস সফলভাবে শেষ করেন। নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে মারজানা বলেন, ‘আমার যাত্রাটা ছিল খুব কঠিন, কিন্তু আমি জানতাম, যদি আমি হাল না ছাড়ি, তবে একদিন এ কষ্টই আমার শক্তি হয়ে দাঁড়াবে। আনাইজা আমার সবচেয়ে বড় প্রেরণা।’

অল্প বয়সেই মারজানার প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বখ্যাত জার্নালে ৯টি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রবন্ধ। তার গবেষণার বিষয় ভাইরোলজি, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) এবং সংক্রামক রোগবিষয়ক।

তার স্বামী ইউশা আরাফ বলেন, মারজানার এ অর্জন শুধু আমাদের পরিবারের নয়, পুরো বাংলাদেশের গর্ব। সে প্রমাণ করেছে, সাহস, বিশ্বাস আর পরিশ্রম থাকলে যে কোনো বাধাই অতিক্রম করা অসম্ভব নয়।

নিজের অর্জন সম্পর্কে মারজানা আরও বলেন, জাতিসংঘের ফেলোশিপে নির্বাচিত হওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতিগুলোর একটি। আমি চাই, এই সাফল্য দেশের মেয়েদের জানাক, কোনো কষ্ট, অসুস্থতা কিংবা বাধা আমাদের স্বপ্নের পথে দাঁড়াতে পারে না। বিজ্ঞানকে মানবকল্যাণে ব্যবহার করাই এখন আমার জীবনের লক্ষ্য।

জাতিসংঘের এই ফেলোশিপের মাধ্যমে মারজানা এখন বৈশ্বিক পর্যায়ে জীববিজ্ঞান ও বায়োসিকিউরিটি বিষয়ে বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করবেন। বিজ্ঞানকে মানবকল্যাণে ব্যবহারের এই প্রয়াসে তার অবদান ভবিষ্যতের তরুণ বিজ্ঞানীদের জন্য এক অনুপ্রেরণার গল্প হয়ে থাকবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বদলির আদেশের ৩ সপ্তাহ পরও অফিস করছেন রাসিক সচিব

ড. তোফায়েল আহমেদ মারা গেছেন

চার দিন ধরে নিখোঁজ বিকাশ কর্মী ওমর ফারুক

ওসির বিরুদ্ধে দুর্বল ধারার অভিযোগ, আ.লীগ নেতার ৩ সন্তানের জামিন

বরিশালে মা ইলিশ রক্ষায় নৌবাহিনী, চার দিনে ১০৪ জেলের কারাদণ্ড

উচ্ছেদের পর অবৈধ স্থাপনার বৈধতা দিতে তোড়জোড়

ধর্ষণের আলামত গায়েব, ওসিসহ দুজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

সীমান্তে দেড় কোটি টাকার কষ্টি পাথরের মূর্তি উদ্ধার

রাজধানীতে যুবলীগ নেত্রী লাবণ্য ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা আমির হামজা গ্রেপ্তার

কাঁচা নাকি পাকা পেঁপে, কোনটি ভালো জেনে নিন

১০

পাঁচ দফা দাবিতে নারায়ণগঞ্জ নগরভবন ঘেরাও

১১

টাইফয়েড টিকা : যেসব উত্তর জানা জরুরি

১২

দুদিনের কর্মসূচি নিয়ে জামায়াতের নতুন বার্তা

১৩

আফগানিস্তানের সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান রাশিয়ার

১৪

২৮০-এর কথা বলে ২২১ রানেই শেষ বাংলাদেশ

১৫

ওমানে মাছ ধরে বাসায় ফেরা হলো না ৮ বাংলাদেশির

১৬

সাংবাদিক শহীদুল আলমকে আটকে রিজভীর উদ্বেগ

১৭

নির্বাচন নিয়ে যে কোনো ষড়যন্ত্র শক্ত হাতে মোকাবিলা করা হবে : কফিল উদ্দিন

১৮

দুদিন পর উদযাপিত হবে জবির এবারের বিশ্ববিদ্যালয় দিবস

১৯

দেশের বাজারে স্বর্ণের দামে বড় লাফ, ফের ইতিহাস

২০
X