কাগজে-কলমে নিষিদ্ধ থাকলেও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) বন্ধ নেই শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতি। মিছিল-সমাবেশ না থাকলেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। অনেকেই ক্যাম্পাসের বাইরে সাংগঠনিক কাজে সক্রিয়। আবার ক্যাম্পাসে স্বীকৃত ছাত্র সংগঠনগুলোর অনুপস্থিতির সুযোগে ভেতরে ভেতরে সংগঠিত হচ্ছে নানা শক্তি। নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা কাগজেই সীমাবদ্ধ রয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত যেটুকু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাও রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে গত ৮ আগস্ট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত না হওয়ার শপথও নেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাত থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত বুয়েটের শেরেবাংলা হলে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের কিছু কর্মী। এ ঘটনার পর ক্যাম্পাসে সব রকম রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানান শিক্ষার্থীরা। একই দাবিতে দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। সেই প্রেক্ষাপটে ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে বুয়েট কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বুয়েটে সব রাজনৈতিক সংগঠন এবং এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কোনো শিক্ষার্থী অনুমোদিত ক্লাব-সোসাইটি ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দল বা এর অঙ্গসংগঠনের অথবা অন্য কোনো সংগঠনের সদস্য হতে বা এর কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের নিয়মগুলো যথাযথভাবে পালন করতে হবে এবং এগুলো অমান্য করলে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে বুয়েটের কোনো শিক্ষার্থীকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অন্য কোনো মাধ্যমেও সাংগঠনিক-রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার না করারও নির্দেশ দেওয়া হয়।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ওই নির্দেশনার পরপরই বদলে যায় বুয়েটের পরিবেশ। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হেনস্তা ও র্যাগিং প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রাজনীতি নিষিদ্ধের পর এ সংস্কৃতি বন্ধ হয়। এ ছাড়া সেখানকার সার্বিক পরিবেশ, আবাসিক হলের সুযোগ-সুবিধা ও খাবারের মানেও পরিবর্তন আসে।
তবে কর্তৃপক্ষের এই নির্দেশনা খুব বেশিদিন কার্যকর থাকেনি। কিছু দিনের মধ্যেই গোপনে ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২০ সালের ২৪ জুলাই জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বুয়েট শাখার কমিটি ঘোষণা করা হয়। পাঁচ সদস্যের ওই কমিটিতে আসিফ হোসেন রচিকে আহ্বায়ক ও আলী আহমদকে সদস্য সচিব করা হয়।
ছাত্রদল নেতারা জানান, আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পরপরই রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের দায়ে আসিফ হোসেন রচিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ। তার পরও ঘোষিত কমিটি বহাল রাখা হয়। বুয়েটের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক কার্যক্রম সচল রয়েছে বলেও দাবি তাদের।
বুয়েট শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক আসিফ হোসেন রচি কালবেলাকে বলেন, ‘যখন কমিটি হয়েছে তখন আমি মাস্টার্সে পড়তাম। কিন্তু ছাত্রদল করার কারণে আমার ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়। আমাদের সঙ্গে বর্তমানে নিয়মিত শিক্ষার্থীরাও রাজনীতি করছেন। তাদের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হয়। ক্যাম্পাসের বাইরে আমাদের কার্যক্রমে তারা অংশ নিচ্ছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আসলে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। ছাত্রলীগের বুয়েটের দুই নেতাকে কেন্দ্রে পদ দেওয়া হয়েছে। আমাদের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থা নিলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।’
অন্যদিকে আবরার ফাহাদ হত্যার সঙ্গে সংগঠনের কর্মীরা জড়িত থাকায় বুয়েটে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়ে ছাত্রলীগ। রাজনীতি নিষিদ্ধের পর থেকেই তারা অনেকটা নীরব ভূমিকা পালন করছিল। তবে ইসলামী ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসে কার্যক্রম চালাচ্ছে—এই অভিযোগ তুলে প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করেও ভিন্ন ভূমিকা পালন করেছে ক্ষমতাসীন দলের এই সহযোগী সংগঠন। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের একাংশ এর প্রতিবাদ জানায়। সমালোচনার মুখে পিছু হটে ছাত্রলীগ। তবে রাজনীতি শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার দাবি করে বুয়েট ক্যাম্পাসে আবারও ছাত্রলীগের রাজনীতি সক্রিয় করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, ছাত্রলীগের ৩০১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে হাসিন আজফার পান্থ তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক এবং ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম রাব্বিকে সদস্য করা হয়েছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে সমালোচনা হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে জেলার নাম দিয়ে তাদের কমিটিতে বহাল রাখা হয়। তবে তাদের বিরুদ্ধে বুয়েট প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। যদিও পরে কমিটি থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম রাব্বি।
কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো চাপ প্রয়োগ করেনি। একাডেমিক ও ব্যক্তিগত কারণে আমি অব্যাহতি নিয়েছি।’
জানা গেছে, আগামী শুক্রবার স্মরণকালের সর্ববৃহৎ ছাত্র সমাবেশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ছাত্রলীগ। সমাবেশ সফল করার লক্ষ্যে গঠিত সমন্বয় কমিটির তালিকায় আছেন বুয়েটের দুই শিক্ষার্থী।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসাইন কালবেলাকে বলেন, ‘বুয়েটের একজন শিক্ষার্থী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হবে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেবে, এটি তার সাংবিধানিক অধিকার। বুয়েটের একাডেমিক পরিবেশ সুন্দর রাখার পাশাপাশি পরিবর্তনশীল ও ইতিবাচক ছাত্র রাজনীতিও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। যদি ছাত্র রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন আনতে হয়, তাহলে আমরা সেটি করে নেব। অপরাজনীতির সমাধান হচ্ছে আরও ভালো ছাত্র রাজনীতি। আমরা মনে করি, বুয়েট শিক্ষার্থীরা আরও যুগোপযোগী ছাত্র রাজনীতি নিশ্চিত করে গোটা বাংলাদেশের ছাত্রসমাজকে পথ দেখাবে।’
জানা গেছে, শুধু ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল নয়, বুয়েট ক্যাম্পাসে কয়েকটি বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রমও চলমান রয়েছে। আর ইসলামী ছাত্রশিবির ধারাবাহিকভাবেই গোপনে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে গুঞ্জন রয়েছে।
অবশ্য ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি সালমান সিদ্দিকী কালবেলাকে বলেন, বুয়েটে আমাদের কার্যক্রম নেই। তবে যোগাযোগ আছে। অন্যান্য বাম সংগঠনেরও প্রায় একই অবস্থা। বুয়েটে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ দরকার। কিন্তু সেটি সেখানে নেই।’
তিনি বলেন, ‘বুয়েটের আবরার হত্যার জন্য দায়ী ছাত্রলীগ। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করায় শিক্ষার্থীদের বড় ক্ষতি হলো। সাধারণ শিক্ষার্থীরা হয়তো এটিকে সাধুবাদ জানিয়েছে; কিন্তু গভীরভাবে দেখলে বোঝা যাবে যেখানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়, সেখানে শিক্ষার পরিবেশ থাকে না।’
শিবিরের রাজনীতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘একটি অন্ধকার পরিবেশে অন্ধকার শক্তি সামনে আসবে, এটাই স্বাভাবিক। ছাত্র শিবির কখনো জনগণ কিংবা সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ায় না। তাদের কর্মপদ্ধতি হচ্ছে গোপনে কাজ করা। যে কারণে বুয়েটে তাদের আস্তানা রয়েছে কি না, তা বলা সম্ভব নয়।’
তবে বুয়েট ক্যাম্পাসে কোনো ছাত্র সংগঠনের কর্মকাণ্ড নেই বলে দাবি করেন ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক (ডিএসডব্লিউ) অধ্যাপক মিজানুর রহমান। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘বুয়েটে বর্তমানে কোনো ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা নেই। কেউ গোপনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হলে আমাদের পক্ষে তা শনাক্ত করা সম্ভব নয়। এমন কিছু নজরে এলে আমরা সবসময় ব্যবস্থা নিই। গোপন সংগঠনের ব্যাপারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বলা আছে। কেউ আমাদের সুনির্দিষ্ট তথ্য দিলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হলেও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকা দুজনের বিষয়ে প্রশাসন নীরব— এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ছাত্রদল কমিটি ঘোষণা করলেও সেখানে জায়গা পাওয়া কেউ নিয়মিত শিক্ষার্থী নন। আর ছাত্রলীগের কমিটিতে দুজনকে রাখা হয়েছিল। তাদের একজন পাস করে বের হয়ে গেছেন। আরেকজন বর্তমান শিক্ষার্থী এবং তিনি ওই কমিটি থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন।’
মন্তব্য করুন